চিকিৎসা নিয়ে রাশিয়া থেকে ফিরেছেন গুলিতে নাক, চোখ, ঠোঁট হারানো সেই খোকন
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুলিতে খোকন চন্দ্র বর্মণ (২৩) মুখমণ্ডলে গুরুতর আঘাত পান। তাঁর ওপরের ঠোঁট, মাড়ি, নাক, তালু, বাঁ চোখের কোনো অস্তিত্ব নেই। সে জায়গায় বড় একটি গর্ত তৈরি হয়েছে। সরকারি খরচে গত ২১ ফেব্রুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য খোকনকে রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার শেষে আজ বুধবার দেশে ফিরেছেন খোকন।
খোকন রাশিয়ায় অবস্থানের সময় তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নূরজাহান বেগমের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান। প্রথম আলোকে তিনি জানান, কাতার এয়ারলাইনসের একটি ফ্লাইটে আজ সকালে দেশে ফিরে এসেছেন তাঁরা। রাশিয়ায় আরও দুই ধাপে অস্ত্রোপচার হবে খোকনের। সেসব অস্ত্রোপচারে খোকনের মুখের অবয়ব তৈরি, নাক পুনর্গঠন ও বাঁ চোখে কৃত্রিম চোখ স্থাপন করা হবে।
খোকনের চিকিৎসার বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে মাহমুদুল হাসান জানান, গত ২২ এপ্রিল রাশিয়ার স্থানীয় একটি হাসপাতালে খোকন চন্দ্র বর্মণের প্রথম ধাপের অস্ত্রোপচার সফলভাবে হয়। খোকনের মুখের পুনর্গঠন অস্ত্রোপচারের (রিকনস্ট্রাকশন সার্জারি) লক্ষ্যে প্রথমে খোকনের মুখের থ্রি–ডি মডেল তৈরি করা হয়। পরে তাঁর নিচের চোয়ালে (ম্যান্ডিবল) টাইটানিয়ামের পাত বসানো হয় এবং অস্টিওসিন্থেসিস করা হয়। অস্ত্রোপচারের সময় খোকনের মুখ থেকে তিন–চারটি ছররা গুলির অংশবিশেষ বের করা হয়।
খোকন চন্দ্র বর্মণকে নিয়ে প্রথম আলো একাধিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ৬ এপ্রিল রাশিয়ায় খোকনের চিকিৎসা নিয়ে ‘পাঁজরের হাড় ও কপালের চামড়ায় তৈরি হবে সেই খোকনের নাক’ শিরোনামের খবর প্রকাশিত হয়।
খোকন পেশায় গাড়িচালক ছিলেন। গত ৫ আগস্ট দুপুরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার সামনে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ওই দিনের একটি ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, গুলিতে খোকনের ঠোঁট, মাড়ি, নাক-মুখের অংশের মাংস প্রায় খুলে পড়ছে। তাঁর মুখ ও পুরো শরীর রক্তাক্ত। এ অবস্থায়ও তিনি একজনের হাত ধরে উঠে দাঁড়ান। খোকন নিজেই আঙুলের ছাপ দিয়ে মুঠোফোনের লক খোলেন। সেই মুঠোফোন থেকেই একজন খোকনের বড় ভাই খোকা চন্দ্র বর্মণকে গুলি লাগার খবর দেন। খোকনের বাবা কিনা চন্দ্র বর্মণ রাজধানীর একটি হাসপাতালে শাকসবজি, মাছ-মাংস সরবরাহ করেন। মা রীনা রানী দাস এক বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করেন। খোকনের ছোট ভাই শুভ চন্দ্র বর্মণ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ছে। খোকন পড়েছেন পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত।
ঘটনার সময় খোকা ও খোকন একই কোম্পানিতে গাড়ি চালাতেন। খোকন যাত্রাবাড়ীতে থাকতেন। আর খোকা মা-বাবা ও ছোট ভাইকে নিয়ে মহাখালীর সাততলা বস্তিতে থাকতেন।
গুলিতে মুখমণ্ডলে গভীর ক্ষত হওয়ায় ঢাকায় জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে থাকার সময় এবং রাশিয়ায়ও খোকনকে মুখ সাদা গজ কাপড় দিয়ে ঢেকে চলাফেরা করতে হতো, যাতে অন্যরা ভয় না পান। খোকন দেশে ও রাশিয়ায় থাকার সময় তাঁর সঙ্গে প্রথম আলোর একাধিকবার কথা হয়। আগের চেহারা আবার ফিরে পাবেন কি না, তা নিয়ে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। রাশিয়ায় চিকিৎসা শুরুর জন্য সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সুস্থতার জন্য দেশবাসীর কাছে দোয়া চান।
খোকনের পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা নিয়ে পেশায় সার্জন মাহমুদুল হাসান বলেছেন, দ্বিতীয় ধাপের অস্ত্রোপচারে ওপরের চোয়াল (ম্যাক্সিলা) পুনর্গঠন করা হবে। পুরো অস্ত্রোপচারের এই দ্বিতীয় ধাপটি সবচেয়ে জটিল। এই অস্ত্রোপচারের ওপর খোকনের মুখের অবয়ব নির্ধারিত হবে। এই জটিল অস্ত্রোপচার রাশিয়ার একজন জাতীয় অধ্যাপকসহ তিনজন অধ্যাপক করবেন। অস্ত্রোপচারটি জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে হওয়ার কথা রয়েছে। জুলাই মাসে খোকনের বাঁ চোখের এনুক্লেশন করা হবে। এটা একধরনের অস্ত্রোপচারপদ্ধতি, যার মাধ্যমে চোখের বল ও আশপাশ অপসারণ করা হয়।
মাহমুদুল হাসান আরও জানান, তৃতীয় ধাপে খোকনের নাক তৈরির জন্য অস্ত্রোপচার করা হবে। তাঁর বুকের পাঁজরের হাড় থেকে নাক তৈরি করা হবে। এ বছরের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর মাসে এই সর্বশেষ ধাপের অস্ত্রোপচার হতে পারে। চিকিৎসার সম্পূর্ণ খরচ বহন করবে সরকার।