সাক্ষাৎকার: মোহাম্মদ খোরশেদ আলম

সিরামিক উৎপাদন কেন্দ্র হবে বাংলাদেশ

বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প বর্তমানে প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, মানোন্নয়ন ও রপ্তানিতে নতুন দিগন্ত। অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বললেন আকিজবশির গ্রুপের চিফ অপারেটিং অফিসার মোহাম্মদ খোরশেদ আলম। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন শামসুল হক মো. মিরাজ

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প বর্তমানে কোন অবস্থানে? পাঁচ বছরের প্রবৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—চ্যালেঞ্জ কী? 

খোরশেদ আলম: বাংলাদেশের সিরামিক শিল্প এখন প্রযুক্তিভিত্তিক প্রবৃদ্ধির পর্যায়ে এবং রপ্তানির বড় সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে আছে। গত পাঁচ বছরে নির্মাণ খাতের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি শিল্পটি একটি স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার বাজারের ৮৫ শতাংশই দেশীয় উৎপাদন। একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য এবং আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চলে বাংলাদেশের সিরামিক পণ্যের চাহিদা বাড়ছে।

অটোমেশন প্রযুক্তি, উদ্ভাবনী ডিজাইন এবং মান উন্নয়নের ফলে ভবিষ্যতে নির্মাণসামগ্রী, গৃহসজ্জা, অভ্যন্তরীণ সৌন্দর্যবর্ধনের সমাধান এবং রপ্তানিভিত্তিক উৎপাদন খাতে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি দেখা যাবে। নগরায়ণ, মেগা প্রকল্প, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণির ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধিই এই প্রবৃদ্ধির প্রধান চালিকা শক্তি।

এই চাহিদা পূরণে আকিজবশির গ্রুপ উচ্চ মানের, নান্দনিক এবং টেকসই পণ্য তৈরিতে জোর দিচ্ছে। প্রযুক্তি, নকশা ও টেকসই উপাদানের সংমিশ্রণে এমন পণ্য তৈরি হচ্ছে, যা স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতা করতে সক্ষম। 

প্রথম আলো:

সিরামিক শিল্পের উন্নয়নে আকিজ বশির গ্রুপের অবদান এবং প্রযুক্তি–অটোমেশন, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই উৎপাদনে উদ্যোগ কী?

খোরশেদ আলম: আকিজ বশির গ্রুপ সিরামিক শিল্পে ডিজাইন–সেন্ট্রিক ও প্রযুক্তিনির্ভর পূর্ণাঙ্গ উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। উন্নত মানের অটোমেশন, রোবোটিক প্রযুক্তি এবং আধুনিক মেশিনারি ব্যবহারে আন্তর্জাতিক মানের পণ্য তৈরি করা হচ্ছে। 

এই গ্রুপের গৃহীত কিছু উদ্যোগ—

কারখানায় আধুনিক অটোমেশন ও ইআরপি পদ্ধতি চালু। পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি—বর্তমানে ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ সৌরশক্তি থেকে, ভবিষ্যতে ৪০০ মেগাওয়াট উৎপাদনের পরিকল্পনা। পার্টিকেল বোর্ড বর্জ্য ধুলাকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে দৈনিক প্রায় সাড়ে ৭ লাখ ঘনফুট গ্যাস সাশ্রয়। অপচয় হওয়া তাপ পুনরুদ্ধার করে উৎপাদনে ব্যবহার, যা ১৫ হাজার বর্গমিটার টাইলস উৎপাদনকে সহায়তা করছে। প্রতি বর্গমিটার টাইলস উৎপাদনে ১৩ শতাংশ কার্বন নির্গমন হ্রাস, যা বছরে প্রায় আড়াই লাখ গাছ বাঁচানোর সমতুল্য। শক্তিশালী গবেষণা ও উন্নয়ন সুবিধা—নতুন ডিজাইন, উপকরণ ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছে আকিজ।

প্রথম আলো:

দেশে সিরামিক ব্যবহারের প্রবণতা ও আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান কী?

খোরশেদ আলম: দেশে সিরামিক ব্যবহারের চাহিদা দ্রুত বাড়ছে। গ্রাহকের রুচি, নান্দনিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নকশানির্ভর সিরামিকের দিকে এগোচ্ছে শিল্পটি। বড় আকারের টাইলস, ন্যাচারাল স্টোন, হাই-গ্লস ও ম্যাট–স্পেশাল এফেক্ট ফিনিশ, লাক্সারি স্যানিটারি ও টেবিলওয়্যার ডিজাইন এবং নান্দনিক সব সমাধান বেশি জনপ্রিয় হচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাজারেও বাংলাদেশ এখন শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে—উন্নত মান, প্রতিযোগিতামূলক দাম এবং বৃহৎ উৎপাদনক্ষমতার কারণে। দক্ষিণ এশিয়া, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যের বাজারে কদর বাড়ছে।

আকিজ বশির গ্রুপ রপ্তানি বৃদ্ধির লক্ষ্যে যেসব উদ্যোগ নিয়েছে—আইএসওসহ আন্তর্জাতিক মানের সনদ অর্জন করেছে। নকশার বৈচিত্র্যে গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে রপ্তানিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রশিক্ষণ চালু করেছে। বিশ্বব্যাপী ব্র্যান্ড বিল্ডিংয়ের জন্য আন্তর্জাতিক বাণিজ্য প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ ও বিদেশি পরিবেশক অংশীদার নিয়োগে প্রস্তুতি চলছে। 

প্রথম আলো:

বাংলাদেশ সিরামিক এক্সপোর উদ্দেশ্য এবং আকিজের নতুন উদ্যোগ কি থাকছে? 

খোরশেদ আলম: বাংলাদেশ সিরামিক এক্সপোর প্রধান উদ্দেশ্য—বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পের অগ্রগতি, সক্ষমতা এবং নতুন বাজার সম্ভাবনা তুলে ধরা। বর্তমানে দেশে ৭০টির বেশি কারখানা, ৮ হাজার কোটি টাকার স্থানীয় বাজার এবং ৫০টির বেশি দেশে রপ্তানি করা হয়—বার্ষিক রপ্তানি আয় প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।

এবারের এক্সপোতে অংশ নিয়ে আকিজ বশির গ্রুপ নতুনত্ব নিয়ে আসছে। আর্কফিউচার নামে আর্কিটেকচার শিক্ষার্থী এবং তরুণ স্থপতিদের জন্য একটি প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ৩য়–৫ম বর্ষের শিক্ষার্থী এবং ৩৫ বছরের নিচের প্র্যাকটিসিং স্থপতিরা অংশ নিতে পারছেন।

প্রথম আলো:

বিশ্বমানের সিরামিক উৎপাদনে ব্যবহৃত প্রযুক্তি এবং কোন উপখাত দ্রুত বাড়ছে?

খোরশেদ আলম: বর্তমানে অটোমেশন, ডিজিটাল প্রিন্টিং এবং রোবোটিক হ্যান্ডলিং বিশ্বমানের সিরামিক উৎপাদনের মূল প্রযুক্তি। এসব প্রযুক্তির কারণে উৎপাদন দ্রুত, সাশ্রয়ী ও নির্ভুল হয়।

দ্রুত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত উপখাত— টাইলস (মেঝে, দেয়াল, বাথরুম), স্মার্ট সিরামিক পণ্য, অ্যান্টি–স্কিড টাইলস, ইলেকট্রিক সিরামিক মগ ও জ্বালানিসাশ্রয়ী স্যানিটারি সমাধান। এ ছাড়া আকিজ বশির গ্রুপ জ্বালানিসাশ্রয়ী প্রযুক্তি, সৌরবিদ্যুৎ, পুনরুৎপাদন এবং অপচয় কমানোর প্রকল্পগুলোতে বিনিয়োগ করছে।

প্রথম আলো:

কাঁচামালের দাম, জ্বালানিসংকট ও মুদ্রাবাজারের অস্থিতিশীলতা শিল্পকে কীভাবে প্রভাবিত করছে এবং আকিজের কৌশল কী?

খোরশেদ আলম: বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যবসায়িক পরিবেশে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি, আমদানিনির্ভর কাঁচামালের অপ্রত্যাশিত দামের ঊর্ধ্বগতি এবং অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা। সিরামিক শিল্পের ৯০ শতাংশ কাঁচামাল আমদানিনির্ভর। ডলার–সংকট, এলসি জটিলতা, শুল্ক–অস্থিরতা এবং বিদ্যুৎ–গ্যাসের অনিয়ম সরাসরি উৎপাদনে প্রভাব ফেলছে। এতে পরিচালন খরচ বাড়ে এবং প্রতিযোগিতামূলক দাম ধরে রাখা কঠিন হয়।

প্রথম আলো:

সিরামিক শিল্পে কর্মসংস্থান পরিস্থিতি এবং দক্ষ জনবল তৈরির চ্যালেঞ্জ কী?

খোরশেদ আলম: সিরামিক শিল্পে বর্তমানে সরাসরি ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৫ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান। দ্রুত নগরায়ণ এবং নির্মাণ বৃদ্ধির কারণে জনবল চাহিদা আরও বাড়ছে। তবে দক্ষ কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন জনবলের ঘাটতি একটি বড় সমস্যা—বিশেষ করে নকশা, যন্ত্র পরিচালনা, মান নিয়ন্ত্রণ ও কারিগরি প্রশিক্ষণে।

আকিজ বশির গ্রুপে ২৫ হাজারের বেশি কর্মী যুক্ত আছেন। নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ওয়ার্কশপ ও ডিজিটাল স্কিল ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।

প্রথম আলো:

সরকারি নীতি ও প্রণোদনা এবং আকিজের নীতিগত প্রস্তাবনা কী?

খোরশেদ আলম: ব্যবসায়িক পরিবেশে সবচেয়ে সহায়ক বিষয় হলো করছাড়, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং বিনিয়োগবান্ধব ব্যাংকিং ব্যবস্থা শিল্পোন্নয়নে সহায়ক। ইপিজেড, শিল্পনগরী, অর্থনৈতিক অঞ্চলের উন্নত অবকাঠামোশিল্পকে এগিয়ে নিচ্ছে।

প্রথম আলো:

আগামী পাঁচ বছরে বাংলাদেশের সিরামিক শিল্পকে কোথায় দেখতে চান?

খোরশেদ আলম: আমার প্রত্যাশা—বাংলাদেশ আগামী পাঁচ বছরে বিশ্বের সিরামিক উৎপাদনের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠবে। রপ্তানিমুখী পণ্যের বৈচিত্র্য ও চাহিদা আরও বাড়বে।

প্রথম আলো:

আকিজবশির গ্রুপের আগামী পাঁচ বছরের বিনিয়োগ পরিকল্পনা কী? 

খোরশেদ আলম: আগামীর পরিকল্পনা—উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো, আধুনিক ডিজাইন ও মানোন্নয়ন, পরিবেশবান্ধব ও ‘জিরো ওয়েস্ট’ শিল্পায়ন, দেশীয় ও রপ্তানি—দুই বাজারেই নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা, সিরামিক শিল্পে দেশের নম্বর ওয়ান ব্র্যান্ডে পরিণত হওয়া।