চট্টগ্রাম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অটোরিকশা, মোটরসাইকেল চলবে না, ক্ষোভ নগরবাসীর

কার ১০০, বাস ৩০০, কাভার্ড ভ্যান ৫০০ টাকা। সিডিএর প্রস্তাবিত টোল আরও কম ছিল। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও টোল দিতে হবে।

চট্টগ্রাম নগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল করতে পারবে না দুই চাকা ও তিন চাকার যান। ছবি সম্প্রতি তোলাছবি: জুয়েল শীল

চট্টগ্রাম নগরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও প্রাইম মুভার ট্রেইলার (কনটেইনার পরিবহনকারী যান) চলতে পারবে না। প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) এসব গাড়ি চালাতে চাইলেও তাতে সায় দেয়নি গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। এই তিন ধরনের গাড়ি বাদ দিয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল সম্প্রতি চূড়ান্ত করেছে মন্ত্রণালয়। গাড়ির ধরন অনুযায়ী, কয়েকটি ক্ষেত্রে সিডিএর প্রস্তাবিত টোলের চেয়ে বেশি টোল নির্ধারণ করেছে মন্ত্রণালয়।

অথচ প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে করা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই এক্সপ্রেসওয়ে সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করার কথা ছিল ওই তিন ধরনের যানগুলোর। এখন তা চলাচলে বাধা দিলে প্রত্যাশিত টোল আদায় নিয়ে সংশয় তৈরি হবে। একই সঙ্গে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণ খরচ উঠতে বেশি সময় লাগবে।

দুই চাকা, তিন চাকার যান ও ট্রেইলার চলতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুল।
মাহমুদ ওমর ইমাম, অধ্যাপক, পুরকৌশল বিভাগ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।

অটোরিকশা ও ট্রেইলর চলাচল করতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত পুরোপুরি ভুল বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, এসব গাড়ি চলতে না দিয়ে প্রকল্পটি অলাভজনক প্রকল্পে পরিণত হবে। এতে হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এক্সপ্রেসওয়ের সুফলও সাধারণ মানুষ পাবেন না। কার, মাইক্রোবাস, জিপজাতীয় গাড়ি ব্যবহারের সামর্থ্য সবার নেই।

চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজার থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত চার লেনের মূল এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দৈর্ঘ্য ১৬ কিলোমিটার। এর নাম মেয়র মহিউদ্দিন চৌধুরী-সিডিএ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। এটিতে ওঠানামার জন্য ১৫টি র‍্যাম্প রয়েছে। ইতিমধ্যে মূল অংশের কাজ প্রায় শেষ হয়েছে। র‍্যাম্পগুলোর কাজ এখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত বছরের ১৪ নভেম্বর এই এক্সপ্রেসওয়ের উদ্বোধন করেন। যদিও এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে যান চলাচল শুরু হয়নি। এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে মোট ব্যয় হচ্ছে ৪ হাজার ২৯৮ কোটি টাকা।

প্রকল্প অনুমোদনের সময় এক্সপ্রেসওয়ে থেকে টোল আদায়ের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। আনুষ্ঠানিক গাড়ি চলাচল শুরুর আগে টোলের হার নির্ধারণ করে একটি প্রস্তাব গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল সিডিএ। এই প্রস্তাবের ওপর গত ফেব্রুয়ারিতে মন্ত্রণালয়ে সভা হয়। সভায় টোলের হার এবং কোন ধরনের গাড়ি চলাচল করতে পারবে, তা চূড়ান্ত হয়।

চলতে পারবে না মোটরসাইকেল, অটোরিকশা

সিডিএ ১২ ধরনের গাড়ির প্রস্তাবিত টোল নির্ধারণ করে একটি তালিকা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই তালিকা অনুযায়ী, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে মোটরসাইকেল (দুই চাকা), সিএনজিচালিত অটোরিকশা (তিন চাকা), কার, জিপ, মাইক্রোবাস, পিকআপ, মিনিবাস, বাস, ট্রাক (৪ চাকা), ট্রাক (৬ চাকা), কাভার্ড ভ্যান এবং ট্রেইলার গাড়ি চলাচলের সুযোগ রাখা হয়েছিল।

সিডিএর প্রস্তাব নিয়ে গত ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার সভাপতি মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন ওই সভায় বলেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল, ট্রেইলার ও অটোরিকশা প্রবেশ করতে দেওয়া সমীচীন হবে না। সভায় তিন ধরনের গাড়ি বাদ দিয়ে টোলের হার চূড়ান্ত করা হয়।

এদিকে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ট কনসালটেন্সি (বিআরটিসি) ২০১৫ সালে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছিল। এতে মোটরসাইকেল, অটোরিকশা বা তিন চাকার যান এবং ট্রেইলার চলাচল করার কথা বলা হয়েছিল। চালুর পর এক্সপ্রেসওয়ে দিয়ে এসব গাড়ি কী পরিমাণ চলাচল করবে এবং তা থেকে কত টোল আদায় হবে, তারও একটা সম্ভাব্য হিসাব দেওয়া হয়েছিল।

ওই হিসাব অনুযায়ী, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে যেসব সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে, সেখান দিয়ে ২০২৪ সালে প্রতিদিন গড়ে ৬৩ হাজার ১৬৫টি গাড়ি চলাচল করার কথা। এর মধ্যে মোটরসাইকেল ৫ হাজার ৫৩৭টি এবং কার ও তিন চাকার যান চলবে ৩৭ হাজার ৫৫১টি। অর্থাৎ মোট গাড়ির দুই-তৃতীয়াংশ হচ্ছে মোটরসাইকেল, কার ও তিন চাকার যান। এ ছাড়া ট্রেইলার চলার কথা ৭৬৬টি। এতে ২০২৪ সালে সম্ভাব্য আয় ধরা হয় ৯৫ কোটি টাকা। আর যত সময় যাবে, তত এসব গাড়ি চলাচলের পরিমাণ বাড়বে, আয়ও বাড়বে।

‘তিন চাকা নিষিদ্ধ কেন’

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে মোটরসাইকেল ও তিন চাকার গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ করায় ক্ষোভ ও হতাশা জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব হয়েছেন নগরবাসী। নির্মাণকাজের জন্য বছরের পর বছর দুর্ভোগে ভুগতে হয়েছে। আর শেষ মুহূর্তে সাধারণ মানুষের বাহন সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিষিদ্ধ করায় তাঁরা পুরোপুরি হতাশ।

পতেঙ্গা এলাকার বাসিন্দা ওয়াহিদ হাসান বলেন, তাঁদের এলাকায় ভালো হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নেই। এ জন্য যেকোনো জরুরি প্রয়োজনে মূল শহরে আসতে হয়। কিন্তু বিমানবন্দর সড়কে বন্দরের পণ্যবাহী গাড়ি, পোশাক কারখানার গাড়ির কারণে প্রায় সময় যানজট লেগে থাকে। তাই মূল শহরে আসতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যায়। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নির্মাণকাজ শুরুর পর পতেঙ্গার মানুষ আশায় ছিলেন, এই এক্সপ্রেসওয়ে হলে যাতায়াতের ভোগান্তি আর থাকবে না। কিন্তু এখন তিন চাকার যান চলতে দেওয়া না হলে সেই আগের ভোগান্তি নিয়ে চলাচল করতে হবে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অনিক হোসাইন নামের একজন লিখেছেন, ‘বাইকের বিষয়টি না হয় মানলাম, কিন্তু তিন চাকা নিষিদ্ধ কেন? ফ্লাইওভার (এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে) পতেঙ্গার মানুষদের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ইমারজেন্সি রোগীর জন্য। মধ্যবিত্তরা কোথায় যাবে?’ ফেসবুকে এমন অসংখ্য মন্তব্য করেছেন নগরবাসী।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস প্রথম আলোকে বলেন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল করতে দেওয়া না হলে মানুষ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের সুফল পাবে না। এক্সপ্রেসওয়ে যাতে সবাই ব্যবহার করতে পারেন, সে জন্য অটোরিকশা চলাচলের অনুমোদনের চিন্তাভাবনা আছে। বোর্ডের অনুমোদন নিয়ে তা করা হবে।

টোল বেশি

এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে যাতায়াতে কারের জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা প্রস্তাব করেছিল সিডিএ। তবে মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে ১০০ টাকা। বাসের ক্ষেত্রে সিডিএর প্রস্তাব ছিল ওঠানামার স্থান ভেদে ২৫০ ও ২৮০ টাকা। মন্ত্রণালয় চূড়ান্ত করেছে ৩০০ টাকা। কাভার্ড ভ্যানের জন্য সিডিএর প্রস্তাব ৪৫০ টাকা আর মন্ত্রণালয় নির্ধারণ করেছে ৫০০ টাকা।

পর্যালোচনা সভায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের জন্য টোল ছাড়া ভ্রমণের সুযোগ রাখার বিষয়ে আলোচনা হলেও তা নাকচ করে দেওয়া হয়েছে।

দুই চাকা, তিন চাকা ও ট্রেইলার চলাচল না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্তকে পুরোপুরি ভুল বলছেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক মাহমুদ ওমর ইমাম। সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রণয়ন কমিটির এই সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, তিন চাকা ও ট্রেইলর অবশ্যই চলতে দিতে হবে। নিচের সড়কে চাপ কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে করা হয়েছে। ওপরের সড়কে যত বেশি গাড়ি নেওয়া যায়, নিচে তত চাপ কমবে এবং যানজট হবে না। এখন যদি এসব গাড়ি এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে এটা হবে পুরোপুরি ভুল সিদ্ধান্ত।