আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র: বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি

বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ভোলা দেশের সবচেয়ে বড় দ্বীপ জেলা। মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীবেষ্টিত এই জেলা প্রকৃতির এক অনন্য সৃষ্টি। এখানকার নদীর ঢেউ, সূর্যাস্তের লাল আভা ও বাতাসে দোলানো গাছপালা মানুষকে আকর্ষণ করে। ভোলার গ্রামীণ পরিবেশ, ধানখেত, ফলের বাগান ও নদীর পাড়ের নিস্তব্ধতা প্রকৃতিপ্রেমীদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়। কিন্তু যখন সংবাদমাধ্যমের প্রধান মনোযোগ থাকে রাজনীতি, অর্থনীতি, অপরাধ ও দুর্নীতির মতো জটিল ও ভারী বিষয়গুলোর দিকে, তখন ভোলার মতো দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছড়িয়ে থাকা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কথা, পাহাড়-নদী-সবুজ গ্রাম কিংবা মানুষের প্রকৃতিসংলগ্ন জীবনযাপনের ছবি পাঠকের কাছে পৌঁছায় না। উঠে আসে না মানুষের সাফল্য ও সংগ্রামের কথা। অথচ বাংলাদেশের মানুষ প্রকৃতির মতোই প্রাণশক্তিতে ভরপুর। তারা প্রতিদিন প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়ে, ঘুরে দাঁড়ায়। এমন অজানা গল্পগুলোতে আছে জীবনের স্পন্দন।

প্রথম আলোর প্রতিদিনের ছাপা পত্রিকায় আঞ্চলিক সংবাদের জন্য আলাদা পাতা থাকলেও সেখানে এসব অজানা গল্প সব সময় তুলে ধরার সুযোগ থাকে না। প্রতিদিন আমরা ৬৪টি জেলার সংবাদকে ১০টি আঞ্চলিক সংস্করণের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছাই। তবু উপেক্ষিত থেকে যায় জেলা ও উপজেলার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির নানা বৈচিত্র্যময় কাহিনি।

তাই সমাজ ও জীবনের চলমান কাহিনিগুলোর পূর্ণতা দিতে প্রথম আলো উদ্যোগ নেয় আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের। যেমন: সিলেট শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য নিয়ে গত বছর বের হয় ‘শহর সিলেট’ নামের চার পৃষ্ঠার ক্রোড়পত্র। এটা ছিল সিলেট বিভাগের পাঠকের জন্য। এভাবে পুরো বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সম্ভাবনা নিয়ে প্রায় পাঁচ বছরে প্রকাশিত হয়েছে প্রায় ৩০০ আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র। সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ কোনো উপলক্ষে জাতীয় ক্রোড়পত্রের বাইরে অঞ্চলভিত্তিক এমন আয়োজন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের যাত্রা শুরু

প্রথম আলোর আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের যাত্রা শুরু ২০২০ সালে। লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল, মানুষ ও সংস্কৃতিকে পাঠকের সামনে নতুন করে তুলে ধরা। বাংলাদেশের বহু অর্জনের সঙ্গে যেমন প্রথম আলোর নাম গভীরভাবে যুক্ত, তেমনি পাঠকের হাতে আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র পৌঁছে দেওয়াটাও এক নতুন অর্জন হিসেবে যুক্ত হয়েছে সেই ধারায়। প্রতিদিনের চলমান সংবাদের ভেতর এই ক্রোড়পত্রগুলো যেন একটুখানি প্রশান্তির নিশ্বাস—যেখানে পাওয়া যায় আশার গল্প, মানুষের মুখে হাসি, আর জীবনের ইতিবাচক স্পন্দন।

আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের সূচনা হয়েছিল এক কঠিন সময়ে। বিশ্বজুড়ে যখন করোনা মহামারির প্রভাব মানুষের জীবনযাপনকে অনিশ্চয়তায় ফেলেছিল—চারদিকে ছিল ভয়, উদ্বেগ আর অর্থনৈতিক মন্দার ছায়া; ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়েছিল, জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল বহু মানুষের; সেই কঠিন সময়ে, মহামারির প্রথম ধাপের শেষ দিকে প্রথম আলো শুরু করেছিল আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের যাত্রা।

শুরুর দিকের ক্রোড়পত্রগুলো মূলত ছিল করোনাকেন্দ্রিক—মানুষ কীভাবে ভয় ও দুঃসময় পেরিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরছে, সে গল্পগুলোই স্থান পেয়েছিল সেখানে। কারও জীবিকার নতুন পথ খোঁজার গল্প, কেউ-বা ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে কীভাবে চেষ্টা করছেন—এসব বিষয় উঠে এসেছিল প্রতিবেদনে। পাশাপাশি শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি অঙ্গনের স্থবিরতা কাটানোর উপায় নিয়েও ছিল বিশদ আলোচনা। অর্থাৎ এই আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রগুলো শুধু খবরের সংকলন ছিল না; ছিল দেশজুড়ে আড়মোড়া ভাঙার প্রচেষ্টার এক অনুপ্রেরণাদায়ী প্রতিচ্ছবি। মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সাহস, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি ও পুনরুদ্ধারের মানসিকতাকেই এগুলোর মাধ্যমে তুলে ধরেছিল প্রথম আলো।

দ্বিতীয় ধাপের আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রগুলোতে প্রথম আলো মনোযোগ দেয় দেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও স্থানীয় উন্নয়নধারায়। মূল বিষয় ছিল ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিভিত্তিক শিল্পে জেলাগুলোর অবস্থান, সম্ভাবনা এবং ভবিষ্যৎ করণীয়। স্থানীয় উদ্যোক্তা, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়ন—এসব বিষয় নিয়ে প্রকাশিত হয় বিশদ প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ। একই সঙ্গে প্রতিটি অঞ্চলের বহুমাত্রিক ঐতিহ্যের অনন্য দিকগুলোও স্থান পায় এই সংখ্যাগুলোতে। যেমন সেরা স্থানীয় খাবার, ঐতিহাসিক নিদর্শন, উল্লেখযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সংস্কৃতির নানা দিক তুলে ধরা হয়।

এরপর আসে তৃতীয় ধাপ—২০২১ সালের মার্চ মাসে, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। এই সময় প্রকাশিত ক্রোড়পত্রগুলোর মূল বিষয় ছিল মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা। এর শিরোনাম ছিল যথাযথভাবেই ‘জনপদের যুদ্ধ’। প্রতিটি জেলায় তুলে ধরা হয় স্থানীয় পর্যায়ের যুদ্ধের ইতিহাস, গণহত্যার স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহী স্থান ও স্মৃতিস্তম্ভ এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের অনুল্লেখিত গল্প। এসব সংখ্যার মাধ্যমে পাঠকেরা তাঁদের নিজস্ব জনপদের বীরত্বগাথা, ত্যাগ ও গৌরবের ইতিহাস নতুনভাবে জানতে পারেন।

শুরুর পর থেকে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কনটেন্টে অনেক পরিবর্তনও এসেছে। পরিবর্তন এসেছে উপস্থাপনেও। পাঠকের আগ্রহ ও সাড়া পেয়ে ক্রোড়পত্রের বিষয়বস্তুও ধীরে ধীরে আরও বহুমাত্রিক হয়েছে। শুরুতে যেখানে মূলত জীবনযাপন ও স্থানীয় উন্নয়ন নিয়ে প্রতিবেদন ছিল, পরে সেখানে যুক্ত হয়েছে জেলা-উপজেলার পাঠাগার, ক্রীড়াঙ্গনের সাফল্য ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা-সম্পর্কিত বিশ্লেষণ।

এ ছাড়া ক্রোড়পত্রগুলোতে উঠে এসেছে স্থানীয় পর্যায়ে সরকারের বড় প্রকল্পগুলোর প্রভাব—যেমন পাবনার রূপপুরে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঘিরে গড়ে ওঠা নতুন ব্যবসা-বাণিজ্য ও জনজীবনের পরিবর্তন। পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জীবন, অর্থনীতি ও ব্যবসার চিত্র নিয়ে প্রকাশিত হয় একাধিক আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র। এতে বিশ্লেষণ করা হয় পদ্মা সেতুর সুবিধা কাজে লাগিয়ে কীভাবে এই অঞ্চলে নতুন শিল্প, পর্যটন ও যোগাযোগের সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাঠকেরা এসব আঞ্চলিক ক্রোড়পত্র গ্রহণ করেছেন। তার প্রমাণ প্রকাশের দিনই সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে প্রথম আলোর প্রচারসংখ্যায় বৃদ্ধি।

শুধু স্থানীয় বিষয় নয়, পরিবর্তনের রেখাচিত্রও

সব মিলিয়ে আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রগুলো শুধু স্থানীয় বিষয়ের সংকলন নয়, এগুলো দেশের পরিবর্তন, উন্নয়ন ও মানুষের সাফল্যের ধারাবাহিক ইতিহাস হয়ে উঠেছে।

সৃষ্টিশীল পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জাতীয় দৈনিকে আঞ্চলিক ক্রোড়পত্রের সংযোজন কেবল একটি সম্পাদকীয় উদ্যোগ নয়—এটি বর্তমানের নানা চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা সংবাদপত্রশিল্পকে নতুনভাবে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে। এই উদ্যোগের প্রভাব বোঝা যায় তিনটি মূল কারণে।

প্রথমত, বিষয়বৈচিত্র্য—জাতীয় বিষয়ের গণ্ডি পেরিয়ে এখন পাঠকের সামনে আসছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলের অনন্য গল্প, স্থানীয় মানুষের জীবনযাপন, সাফল্য, সংস্কৃতি ও সম্ভাবনা। এতে সংবাদপত্রের কনটেন্টে নতুন মাত্রা যোগ হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক পাঠক—যাঁরা এত দিন জাতীয় সংবাদে নিজেদের এলাকার উপস্থিতি খুঁজে পেতেন না, তাঁরা এখন সরাসরি যুক্ত হচ্ছেন। এতে পাঠকের সঙ্গে সম্পর্কও দৃঢ় হচ্ছে।

তৃতীয়ত, আঞ্চলিক বিজ্ঞাপন—স্থানীয় ব্যবসা ও উদ্যোক্তাদের জন্য এটি এক নতুন সুযোগ। তাঁরা এখন তাঁদের নিজস্ব অঞ্চলের পাঠকদের কাছে পৌঁছাতে পারছেন একটি বিশ্বস্ত ও জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।

সব মিলিয়ে প্রথম আলোর এই উদ্যোগ সংবাদপত্রশিল্পে এক নতুন দিগন্তের সূচনা। প্রথম আলোর এই আঞ্চলিক সাংবাদিকতার মডেল বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে। গত মাসে সংবাদ প্রকাশকদের বৈশ্বিক সংগঠন ওয়ান-ইফরায় নতুন প্রজন্মের পাঠক–সম্পৃক্ততা এবং ছাপা পত্রিকায় আঞ্চলিক বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতা—এই দুই ক্যাটাগরিতে প্রথম আলো বিশ্বসেরার পুরস্কার পেয়েছে।

তুহিন সাইফুল্লাহ, সম্পাদক, আঞ্চলিক সংবাদ

প্রথম আলো