আদালতের স্থগিতাদেশ সত্ত্বেও সেই প্রকৌশলীদের পদোন্নতির প্রস্তাব এলজিইডির

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)

প্রকল্প থেকে আসা ২৫৭ প্রকৌশলীর পদোন্নতিসহ অন্যান্য কার্যক্রমের বিষয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও তাঁদের পদোন্নতি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। পঞ্চম গ্রেডের নির্বাহী প্রকৌশলীর শূন্য পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানের লক্ষ্যে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।

যদিও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের চলতি দায়িত্ব প্রদান নীতিমালায় স্পষ্ট বলা আছে, প্রকল্প থেকে আসা কোনো কর্মকর্তা রাজস্ব বাজেটে নিয়মিত না হলে তাঁকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না।

এলজিইডিতে এই ২৫৭ প্রকৌশলীর চাকরি উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর, চাকরি নিয়মিতকরণে নানা অনিয়ম হয়েছে। এমনকি এই প্রকৌশলীদের সপ্তম গ্রেডে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া ও ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া আইনসম্মত হয়নি। নিয়োগের ক্ষেত্রে পাশ কাটানো হয়েছে সব বিধিবিধান। আইনগত সুযোগ না থাকলেও দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি।

এলজিইডিতে উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ২০১০ সালে ১৩১ জন, ২০১১ সালে ১০৯ জন এবং ২০১৩ সালে ১৭ জনকে এলজিইডির রাজস্ব খাতভুক্ত সহকারী প্রকৌশলী (পুর) পদে স্থানান্তর করা হয়।

এসব প্রকৌশলীর চাকরির অনিয়ম নিয়ে ২০২৩ সালের ২৮ জুন এবং ২০২৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোতে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টে রিট করেন আইনজীবী আরিফ চৌধুরী। গত বছরের ২ ডিসেম্বর আদালত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে তদন্ত কমিটি করে তিন মাসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। এর ধারাবাহিকতায় গত ৩ জুলাই বিচারপতি মো. আকরাম হোসেন চৌধুরী ও বিচারপতি ফয়েজ আহমেদের দ্বৈত বেঞ্চে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। তদন্তে এই প্রকৌশলীদের নিয়মিতকরণ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম পায় কমিটি।

তদন্তে যা পাওয়া গেল

তদন্তে দেখা গেছে, রাজস্ব খাতে স্থানান্তরে অর্থ বিভাগ ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সম্মতি গ্রহণের আবশ্যকতা থাকলেও তা গ্রহণ করা হয়নি। উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশ বাধ্যতামূলক। কিন্তু এই ২৫৭ প্রকৌশলীর ক্ষেত্রে পিএসসিরও সুপারিশ নেওয়া হয়নি।

তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, ভূতাপেক্ষ তারিখে নিয়মিত করার সুযোগ না থাকায় সব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে এই প্রকৌশলীদের নিয়মিতকরণের আদেশ জারির বিধিগত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

তদন্ত কমিটির মতে, নিয়মিতকরণ যথাযথভাবে না হওয়ায় তাঁদের জ্যেষ্ঠতা গণনা করারও সুযোগ নেই। এমনকি তাঁদের সপ্তম গ্রেডে সিলেকশন গ্রেড দেওয়া ও ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়ার আইনগত সুযোগ ছিল না। তাঁদের যে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে, সেটি আইনসম্মত হয়নি।

আরও পড়ুন

আরেক ধাপ পদোন্নতির তোড়জোড়

উচ্চ আদালতে মামলার কার্যক্রম চলার মধ্যেই এই প্রকৌশলীদের আরেক ধাপ পদোন্নতি দেওয়ার তোড়জোড় শুরু হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ আগস্ট শুনানিতে ২৫৭ জনের পদোন্নতিসহ অন্যান্য কার্যক্রমের বিষয়ে আদালত স্থগিতাদেশ জারি করেন।

এর মধ্যেই পঞ্চম গ্রেডের নির্বাহী প্রকৌশলীর শূন্য পদে চলতি দায়িত্ব প্রদানের লক্ষ্যে চলতি (সেপ্টেম্বর) মাসের শুরুতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠায় এলজিইডি। এলজিইডির প্রস্তাবের বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিবকে সভাপতি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সম্মেলনকক্ষে ২৩ সেপ্টেম্বর কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

এ বিষয়ে কমিটির সভাপতি স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন) মো. শাহজাহান মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, এলজিইডি থেকে প্রস্তাবের বিষয়ে আলোচনার জন্য সভা ডাকা হয়েছে। আদালতের স্থগিতাদেশ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদনসহ নথিপত্র পর্যালোচনা করেই কমিটি সিদ্ধান্ত নেবে।

চলতি দায়িত্ব মানে সাময়িকভাবে কোনো সরকারি কর্মকর্তাকে তাঁর মূল পদের চেয়ে উচ্চতর কোনো শূন্য পদে দায়িত্ব দেওয়া। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জারি করা ‘শূন্য পদে চলতি দায়িত্ব প্রদান নীতিমালা, ২০২৩’–এর ৮(৮) অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রকল্প থেকে আসা কোনো কর্মকর্তার রাজস্ব বাজেটে নিয়মিতকরণ না হলে তাঁকে চলতি দায়িত্ব প্রদান করা যাবে না। সে ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এলজিইডির এই ২৫৭ জন প্রকৌশলীর চলতি দায়িত্ব পাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

পিএসসির মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া প্রকৌশলীরা বলছেন, প্রকল্প থেকে আসা এই প্রকৌশলীদের কারণে ২০০৮ সালের পর পিএসসির মাধ্যমে এলজিইডিতে নিয়োগ পাওয়া সহকারী প্রকৌশলীরা প্রাপ্য পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও প্রকল্প থেকে আসা প্রকৌশলীদের উচ্চ পদে চলতি দায়িত্ব দেওয়ার কার্যক্রম আদালত অবমাননার শামিল।