বিমানের কেবিন ক্রু নিয়োগে অনিয়ম, আছে বিবাহিত, বেশি পদ সৃষ্টি

প্রতীকী ছবি

রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসে কেবিন ক্রু নিয়োগে অনিয়ম খুঁজে পেয়েছে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। কমিটির সদস্যরা দেখতে পেয়েছেন, মৌখিক পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে হঠাৎ একটি কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে। নিয়োগ পরীক্ষার সব কমিটি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে বিমান মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে।

শুধু তা-ই নয়, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে প্রথমে ৫০ জনের কথা বলা হলেও পরে সেটি সংশোধন করে ১০০ জন করা হয়। চূড়ান্তভাবে আরও একজন বাড়িয়ে মোট ১০১ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শারীরিক মাপদণ্ড পূরণ না হওয়া প্রার্থী যেমন নিয়োগ পেয়েছেন, তেমনি অবিবাহিত হওয়ার শর্ত থাকলেও বিবাহিত প্রার্থীকে নিয়োগ দেওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

দুই মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত শেষে গত আগস্টের শেষ সপ্তাহে কমিটি তাদের প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছে। কমিটির সদস্যরা বলছেন, তাঁরা প্রক্রিয়াগত অনিয়ম দেখেছেন। আর্থিক লেনদেনের বিষয়টি খতিয়ে দেখেননি।

বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের উড়োজাহাজ
ফাইল ছবি

বিমানে আগেও পাইলট ও কেবিন ক্রু নিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে নতুন নিয়োগে অনিয়মের বিষয়টি আবারও সামনে এল।

বিমানের ফ্লাইট স্টুয়ার্ড ও স্টুয়ার্ডেস নিয়োগ পরীক্ষায় দুর্নীতি ও পক্ষপাতমূলক মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া হয়েছে বলে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ে লিখিত অভিযোগ দেন সাইদুজ্জামান মান্না ও রফিকুল ইসলাম নামের দুই ব্যক্তি। তাঁদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ জুন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আনিসুর রহমানকে সভাপতি করে চার সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন একই মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব সফিউল আলম, উপসচিব সাইফুল ইসলাম মণ্ডল ও জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মাহফুজা জেরিন।

তদন্তে প্রার্থীদের উচ্চতা পরীক্ষার সময় দুজনের বিষয়ে অসংগতি দেখা যায়। এ ছাড়া একজন বিবাহিত প্রার্থী পাওয়া যায়, পরে তাঁকে বাদ দেওয়া হয়। চূড়ান্ত ফলাফলে ৫০ জন পুরুষ ও ৫১ জন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিমান থেকে বলা হয়, ৫০তম ও ৫১তম নারী প্রার্থীর নম্বর একই হওয়ায় বাড়তি একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
কমিটির প্রধান আনিসুর রহমান গত ১৪ সেপ্টেম্বর তাঁর দপ্তরে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতিবেদনটি জমা দিয়েছেন। তদন্তে তাঁরা কেবিন ক্রু নিয়োগে প্রক্রিয়াগত অনিয়ম দেখতে পেয়েছেন। তবে নিয়োগে আর্থিক লেনদেন হয়েছে কি না, সেটা গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করা যেতে পারে। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

চূড়ান্ত ফলাফলে ৫০ জন পুরুষ ও ৫১ জন নারীকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিমান থেকে বলা হয়, ৫০তম ও ৫১তম নারী প্রার্থীর নম্বর একই হওয়ায় বাড়তি একজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েও চাকরি

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবিন ক্রু পদে অনেক প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় কম নম্বর পেয়েও চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হন। কেউ কেউ মৌখিক পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েও সুপারিশপ্রাপ্ত হননি।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালের ৩০ এপ্রিল বিমানের ২২৩তম বোর্ড সভায় আইকিউ টেস্টে (বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষমতা পরীক্ষা) ১০০ নম্বরের মধ্যে পাস নম্বর নির্ধারণ করা হয় ৬০। লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বরের মধ্যে ৩০ এবং মৌখিক পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের মধ্যে পাস নম্বর নির্ধারিত হয় ২৫।

কেবিন ক্রুদের মৌখিক নম্বর পর্যালোচনায় দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় ৬০ নম্বরের মধ্যে ৩০ নম্বর পাওয়া বেশির ভাগ প্রার্থী চাকরির জন্য সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। অথচ লিখিত পরীক্ষায় ৪০ নম্বরের বেশি পাওয়া বেশ কয়েকজন প্রার্থী মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেনি বলে প্রতিবেদনে বলা হয়।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মৌখিক পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে কমিটির সভাপতি আবদুর রফিককে বাদ দিয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাফিকুর রহমান নিজেই মৌখিক পরীক্ষা কমিটির সভাপতি হন। এতে দেখা যায়, এমডি নিজে প্রার্থী সুপারিশকারী, আবার নিজেই প্রার্থী অনুমোদনকারী। সদস্যসচিবকেও অন্যত্র বদলি করা হয়।

কমিটি থেকে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি বাদ

২০২২ সালের ১৫ মার্চ বিমানের পরিচালনা বোর্ডের ২৭২তম সভায় জনবল নিয়োগে মোট পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়। সব কমিটিতে বিমানের বাইরের সদস্য হিসেবে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি রাখার সিদ্ধান্ত হয়।

তবে এবারের কেবিন ক্রু নিয়োগের মৌখিক পরীক্ষার ঠিক আগে গত ৫ মে হঠাৎ করে এক প্রশাসনিক আদেশে নিয়োগ কমিটি থেকে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে বাদ দিয়ে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন নিয়ে মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিকে বাদ দেওয়া হয়নি। পুনর্গঠিত কমিটিও পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

এদিকে বিমানের বিভিন্ন নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষার সময় লিখিত পরীক্ষার সঙ্গে প্রার্থীর হাতের লেখা যাচাই করা হয়। তবে এবারের কেবিন ক্রু পদে মৌখিক পরীক্ষার সময় লিখিত পরীক্ষার হাতের লেখা যাচাই করা হয়নি। তদন্ত কমিটি মনে করে, দুই পরীক্ষার হাতের লেখা যাচাই-বাছাইয়ের প্রয়োজন ছিল। যাচাই না করার ফলে সন্দেহ তৈরি হয়।
বিমানের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিমানের নিয়োগপ্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন নতুন নয়। আগেও নিয়োগে অনিয়ম হয়েছে। যেভাবে প্রতিষ্ঠানটির অনিয়ম ধরা পড়ছে, তাতে প্রতিষ্ঠানটির সুনাম ও আস্থা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

এ ধরনের কোনো অনিয়ম ওই নিয়োগে ঘটেনি। সব প্রার্থী সমান ও ন্যায্য সুযোগ পেয়েছেন এবং মেধার ভিত্তিতেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন।
মহাব্যবস্থাপক এ বি এম রওশন কবীর, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস

এমডি নিজেই সুপারিশকারী, অনুমোদনকারী

বিমানের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, কেবিন ক্রু নিয়োগে মৌখিক পরীক্ষা কমিটির সভাপতি করা হয় সংস্থাটির পরিচালক (প্রশাসন) মো. আবদুর রফিককে। সদস্যসচিব করা হয় সংস্থার ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) শফিকুল ইসলামকে।

তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, মৌখিক পরীক্ষার ঠিক আগমুহূর্তে কমিটির সভাপতি আবদুর রফিককে বাদ দিয়ে বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সাফিকুর রহমান নিজেই মৌখিক পরীক্ষা কমিটির সভাপতি হন। এতে দেখা যায়, ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিজে প্রার্থী সুপারিশকারী, আবার নিজেই প্রার্থী অনুমোদনকারী। সদস্যসচিবকেও অন্যত্র বদলি করা হয়। মৌখিক পরীক্ষার আগমুহূর্তে কী কারণে পরিচালনা পর্ষদ সভার অনুমোদন ছাড়া মৌখিক পরীক্ষা কমিটি পুনর্গঠন করা হলো, এ বিষয়ে সংস্থার কাছ থেকে ব্যাখ্যা পায়নি তদন্ত কমিটি।

কমিটির একজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা বোর্ডের সভায় মৌখিক পরীক্ষার কমিটির প্রস্তাব অনুমোদন হয়। এটি বাতিল করতে হলে পর্ষদ সভায় অনুমোদন নিতে হয়। এ ক্ষেত্রে অনুমোদন নেওয়া হয়নি।

বিমানে যেকোনো নিয়োগেই সব সময় স্বচ্ছতার অভাব ছিল। পাইলট, কেবিন ক্রু, এমনকি চালক নিয়োগেও অনিয়ম হয় সংস্থাটিতে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে বারবার এ ধরনের অনিয়ম হচ্ছে, সংস্থার সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
কাজী ওয়াহিদুল আলম, এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ

গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর বিমানের নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে নিয়োগ পান মো. সাফিকুর রহমান। এ বিষয়ে তাঁর বক্তব্য জানতে চাইলে তিনি জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপকের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

মহাব্যবস্থাপক এ বি এম রওশন কবীরের কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি প্রশ্ন লিখিত আকারে দেওয়ার অনুরোধ করেন। প্রশ্ন লিখিত আকারে দেওয়ার পর গতকাল রোববার রাতে লিখিত বক্তব্যে তিনি বলেন, এ ধরনের কোনো অনিয়ম ওই নিয়োগে ঘটেনি। কেবিন ক্রু নিয়োগ প্রক্রিয়া যথাযথ নিয়ম মেনেই হয়েছে। সব প্রার্থী সমান ও ন্যায্য সুযোগ পেয়েছেন এবং মেধার ভিত্তিতেই প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন।

নিয়োগ কমিটির পুনর্গঠনের বিষয়ে তিনি বলেন, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের পরিচালনা পর্যদের তৎকালীন চেয়ারম্যানের নির্দেশে কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল। তবে নিয়োগ কমিটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষতা ও ন্যায্যতার সঙ্গে নিয়োগ প্রক্রিয়া শেষ করেছে। এই পুনর্গঠনের কারণে কোনো প্রার্থী সুবিধা পাননি।

চাকরির জন্য এখনো বিধিমালা হয়নি

কর্মচারী নিয়োগসংক্রান্ত কোনো প্রবিধানমালাও করা হয়নি। নিয়োগ প্রবিধানমালা না থাকায় নিয়োগসংক্রান্ত কমিটি গঠন, পরিবর্তন, পরিমার্জন স্বচ্ছতার সঙ্গে হয়নি বলে কমিটির কাছে প্রতীয়মান হয়েছে। তদন্ত কমিটি বলেছে, সরকারি মালিকানাধীন অন্য কোম্পানিগুলো নিজস্ব নিয়োগ প্রবিধানমালা প্রণয়ন করে স্বচ্ছতার সঙ্গে নিয়োগ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু বিমান কর্মচারী নিয়োগে নিয়োগ প্রবিধানমালা প্রণয়নে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেয়নি। এটি প্রতিষ্ঠানটির দুর্বলতা।

‘বারবার অনিয়মে সুনাম ক্ষুণ্ন’

বিমানে বাড়তি ৫০ জন কেবিন ক্রু কেন বেশি নিতে হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর ২৫ জন কেবিন ক্রু (পুরুষ) এবং ২৫ জন কেবিন ক্রু (নারী) নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে বিমান। তবে ১৫ অক্টোবর এই সংখ্যা দ্বিগুণ করে সংশোধিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। কী কারণে পদসংখ্যা দ্বিগুণ করা হলো, তার কোনো যৌক্তিকতা পায়নি কমিটি।

সব প্রক্রিয়া শেষ করে গত ২৭ মে চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করে বাংলাদেশ বিমান। তাতে ১০১ জনকে কেবিন ক্রু পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

বিমান কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার আগে করপোরেশনের যে চাকরি বিধিমালা ছিল, তা দিয়ে প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরি শর্তাবলি পরিচালিত হচ্ছে। কোম্পানিতে রূপান্তরিত হওয়ার পর নিয়োগসংক্রান্ত শর্তের হালনাগাদ করা হয়নি।

এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিমানে যেকোনো নিয়োগেই সব সময় স্বচ্ছতার অভাব ছিল। পাইলট, কেবিন ক্রু, এমনকি চালক নিয়োগেও অনিয়ম হয় সংস্থাটিতে। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা না হওয়ার কারণে বারবার এই ধরনের অনিয়ম হচ্ছে, সংস্থার সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে। তিনি বলেন, অনিয়ম ঠেকাতে হলে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।