চিত্রকরের অমূল্য সংগ্রহ

শিল্পী মুর্তজা বশীরের মণিপুরিপাড়ার বাসাটি পরিবারের পক্ষ থেকে সংগ্রহশালা হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তাঁর শয়নঘরে রয়েছে শিল্পীর আত্মপ্রতিকৃতি এবং স্ত্রী ও দুই মেয়ের প্রতিকৃতি। বাবার আঁকা ছবির পাশে দুই মেয়ে, বাঁয়ে মুনিজা বশীর ও ডানে মুনীরা বশীর। গতকাল বিকেলে শিল্পীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

তাঁর গুণ ছড়িয়ে পড়েছিল চিত্রকলার সীমানা ছাপিয়ে আরও নানা দিকে। বেঁচে থাকলে মুর্তজা বশীর আজ ৯১ বছর স্পর্শ করতেন। তিনি শারীরিকভাবে গত হলেও তাঁর গুণগ্রাহীরা ঠিকই সমবেত হলেন। তাঁদের স্মৃতিচারণা আর মূল্যায়নে মুর্তজা বশীর উজ্জ্বল হয়ে উঠলেন।

তরুণ বয়সে মুর্তজা বশীর অংশ নিয়েছিলেন মাতৃভাষা আন্দোলনে। মহিরুহসম খ্যাতিমান পিতা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র ছায়ায় না থেকে নিজের যোগ্যতায় বিখ্যাত হতে চেয়ে শিল্পচর্চায় ব্রতী হয়েছেন। নামের শেষাংশ থেকে কেটে দিয়েছেন পারিবারিক পদবি ‘উল্লাহ’।

ছবি আঁকা থেকে শুরু করে উপন্যাস, কবিতা ও চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যসহ লেখালেখির বিভিন্ন ধারায় সৃষ্টিশীলতার স্বাক্ষর রেখেছেন। তাঁর আগ্রহ ছিল আরও বিচিত্র বিষয়ে। গতকাল বৃহস্পতিবার বিকেলে রাজধানীর মণিপুরিপাড়ার একটি আবাসনের ফ্ল্যাটে আয়োজিত অনুষ্ঠানে সুধীজনেরা বিস্মিত হয়ে দেখলেন তাঁর বিচিত্র আগ্রহের বিষয়গুলো।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ থেকে ১৯৯৬ সালে অবসরে যান অধ্যাপক মুর্তজা বশীর। এরপর ঢাকায় চলে আসেন। মণিপুরিপাড়ার এই ফ্ল্যাটে ২০০৩ থেকে ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট করোনায় আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল অব্দি বসবাস করছিলেন তিনি। গতকাল জন্মদিনের অনুষ্ঠানে পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হলো এই শিল্পীর শিল্পকর্ম, তাঁর বিচিত্র বিষয়ের সংগ্রহ প্রভৃতি দিয়ে এই বাসভবন জাদুঘরের মতো গড়ে তোলা হবে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ডাকটিকিটের দুর্লভ সংগ্রহ ছিল মুর্তজা বশীরের। চারুকলা নিয়ে যেসব ডাকটিকিট প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ করেছেন তিনি। সংগ্রহ করেছেন বহু দেশের কাগুজে নোট। আছে খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতক থেকে শুরু করে ব্রিটিশ আমল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের মুদ্রা, বিশেষ করে সুলতানি আমলের মুদ্রার বিশাল সংগ্রহ। এ বিষয়ে ছিল তাঁর বিশেষায়িত জ্ঞান।

এ নিয়ে গবেষণা গ্রন্থ লিখেছেন। সারা ভারত ঘুরে তথ্য সংগ্রহ ও গবেষণা করেছেন মন্দির ও প্রাচীন ভবনের টেরাকোটা নিয়ে। সংগ্রহ করেছেন প্রাচীন পুঁথি, দলিলপত্র, বিচিত্র ধরনের চাবির রিং, ম্যাচবাক্স, তামাক সেবনের কারুকাজখচিত পাইপ, চিত্রিত সরা, শীতল পাটিসহ ঐতিহ্যবাহী কারুপণ্য। সংগ্রহ করেছেন পাথর বসানো আংটি। এর কিছু আবার তাঁর নিজের নকশা করা। সংগ্রহ করেছেন অটোগ্রাফ। গুছিয়ে রেখেছেন তাঁকে লেখা নানাজনের চিঠি, গানের ক্যাসেট, সিডি। নানা বিষয়ের বইয়ের কথা তো বলাই বাহুল্য।

ঘরোয়া এই আয়োজনে তাঁর বড় মেয়ে মুনীরা বশীর জানালেন, ২০২১ সালে তাঁরা মুর্তজা বশীর ট্রাস্ট গঠন করেছেন। উদ্দেশ্য দুটি। এই বাড়িতে শিল্পীর সব সংগ্রহ সংরক্ষণ করা এবং গবেষকদের সুযোগ করে দেওয়া। মুর্তজা বশীরের পাশাপাশি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্‌র চিঠিপত্র ও পাণ্ডুলিপিও গবেষকদের জন্য রাখা হবে। বসার ঘরটি সাজানো হয়েছে শিল্পীর প্রায় অর্ধশত আত্মপ্রতিকৃতি ও ড্রয়িং এবং তাঁকে দেওয়া পদক ও ক্রেস্ট দিয়ে। দুটি শয়নঘরে আছে বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা তাঁর শিল্পকর্ম ও বই। ঘরগুলোকে পরে সংগ্রহশালার আদলে সাজানো হবে।

ঘরোয়া এই আয়োজনে সমবেত হয়েছিলেন তাঁর গুণগ্রাহীরা। তাঁরা কথা বললেন। কথাশিল্পী হাসনাত আবদুল হাই বললেন, মুর্তজা বশীরের বহু বিষয়ে আগ্রহ ও জ্ঞান ছিল। যা করতেন, গুরুত্ব দিয়ে করতেন। ছবি আঁকার ক্ষেত্রে কোনো একটি বিষয়ে আটকে থাকেননি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন নিসার হোসেন বলেন, মুর্তজা বশীর অল্প রেখায় অসাধারণ ড্রয়িং করতে পারতেন। আলোচনায় আরও অংশ নেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী, আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুন, ঢাকা জাদুঘরের কিউরেটর আছিয়া খানম, শিল্পী মোস্তফা জামান, বাংলাদেশ ফিলাটেলিক সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল কাদির। মুর্তজা বশীরের কবিতা আবৃত্তি ও গান করেন তাঁর জামাতা কায়েস চৌধুরী। সবাইকে ধন্যবাদ জানান ছোট মেয়ে মুনিজা বশীর।