‘সাহিত্যের মিত্র মনুষ্যত্ব, শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ’

কালি ও কলম পত্রিকার ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে (বাঁ থেকে) সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, চিন্ময় গুহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, রফিকুন নবী, মুনতাসীর মামুন, আবুল খায়ের ও সুব্রত বড়ুয়া। গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়েছবি: প্রথম আলো

মানুষের চেতনার সব বোধ, দর্শন, যুক্তি, ইতিহাস—সবকিছু নিয়েই সাহিত্যের পরিধি। সেই পরিধি বিস্তৃত হয় আলোচনা ও ভাবনার আদান–প্রদানের মধ্য দিয়ে। সাহিত্য সম্মেলন হচ্ছে সেই জায়গা, যার উদ্দেশ্যই হচ্ছে সংযোগ ঘটানো। এখান থেকে উঠে আসে নতুন যাত্রার বহু নতুন পথ।

‘কালি ও কলম’ সাহিত্য সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উঠে এলো এসব কথা। সাহিত্য, শিল্প–সংস্কৃতিবিষয়ক মাসিক পত্রিকাটির ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত হচ্ছে তিন দিনের এ সম্মেলন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ধানমন্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে শুরু হয়েছে সম্মেলন।

কালি ও কলম পত্রিকার যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে। প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি ছিলেন প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। প্রতিষ্ঠাকালীন সম্পাদক ছিলেন আবুল হাসনাত। ২০২০ সালের ১ নভেম্বর প্রয়াত হওয়ার আগ পর্যন্ত পত্রিকাটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন তিনি।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মূল বক্তব্য দেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।  তিনি পাঠ করেন 'সাহিত্যের শত্রু ও মিত্র’ নামে প্রবন্ধের অংশবিশেষ। সেখানে উল্লেখ করেন সাহিত্যের মিত্র হচ্ছে মানুষের মনুষ্যত্ব। শত্রু হচ্ছে পুঁজিবাদ। মনুষ্যত্ব মানুষকে যুক্ত করে আর পুঁজিবাদ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে। তিনি বলেন, সাহিত্যের সঙ্গে দর্শন ও ইতিহাসের যোগ থাকে। তবে সাহিত্যের স্রষ্টারা দর্শনকে সরলীকরণ করেন না; বরং তাদের প্রয়াস থাকে সর্বজনীন করে তোলায়। অনেক সময় দর্শন যা পারে না, সাহিত্য তা–ও করার ক্ষমতা রাখে।

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর বক্তব্যে উঠে আসে বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল থেকে শুরু করে ফ্রানৎস কাফকার বিভিন্ন সৃষ্টিকর্মের তুলনা। তিনি বলেন, আজকের সংকট তৈরি হচ্ছে পুঁজিবাদের জন্য। এই সংকট নিরসন করতে হলে আমাদের বড় আশ্রয় সাহিত্য।

মূল বক্তব্যের ওপর আলোচনা করেন ইতিহাসবিদ, গবেষক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। তিনি বলেন, সবকিছু কার্ল মার্ক্সের দৃষ্টিতে দেখা হলে তা নিরপেক্ষ হয় না। পুঁজিবাদের বিপক্ষে গিয়ে সাহিত্য কোথায় আশ্রয় নেবে? সেটি সমাজতন্ত্র হতে পারে না। সেখানেও সৃষ্টিশীলতার প্রতি নির্যাতনের অনেক উদাহরণ রয়েছে।  

প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চিন্ময় গুহ বলেন, এখন থেকে কুড়ি বছর আগে দুই বাংলার মাঝখানে প্রদীপ হাতে এসেছিল কালি ও কলম। এখন সে পরিণত একটি পত্রিকা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মের আগে ঢাকা থেকে তিনটি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ঢাকার সাহিত্যের ইতিহাস বহু আগে থেকেই গৌরবের।

কালি ও কলম প্রকাশক আবুল খায়ের বলেন, আমাদের দেশে সংযোগ স্থাপন অনেক সহজ কেননা, সবাই এক ভাষার মানুষ। সাধ ও সাধ্যের সমন্বয় করে একটি কালি ও কলম প্রকাশ করা অসাধ্য সাধনের মতো। তিনি বলেন, ২০ বছরে এ সাহিত্য পত্রিকাটির প্রকাশ কখনো বন্ধ হয়নি। এটি সম্ভব হয়েছে অনেকের সহযোগিতার জন্য।
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সভাপতি বরেণ্য শিল্পী, ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুন নবী বলেন, সাহিত্য, শিল্পকলা, চিত্রকলার সবই আসলে মানুষকে নিয়েই। আবুল হাসনাতের প্রয়াণ কালি ও কলম–এর জন্য ক্ষতি হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তবুও শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এ পত্রিকার সবকিছুর সঙ্গে আমরা আছি।

যেকোনো সাহিত্য সম্মেলনেই মননশীল সৃষ্টির ভাবনার আদান-প্রদান ঘটে বলে স্বাগত বক্তব্যে উল্লেখ করেন ইমেরিটাস অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। তিনি বলেন, এতে সামনে তাকানোর পথটা আরও অর্থপূর্ণ হয়। এই আয়োজনেরও উদ্দেশ্য সেই মননশীল ভাবনার আদান-প্রদান করা।  

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন কালি ও কলম সম্পাদক সুব্রত বড়ুয়া। অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক লুভা নাহিদ চৌধুরী। শুরুতেই তিনি ভাষাশহীদদের সঙ্গে স্মরণ করেন প্রয়াত কবি বেলাল চৌধুরী, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সুবীর চৌধুরী, এ জেড এম আব্দুল আলী এবং কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাতসহ প্রয়াত গুণীজনদের। তাঁদের স্মরণ করে শ্রদ্ধা জানান তিনি।

কালি ও কলম–এর ২০ বছর নিয়ে একটি তথ্যচিত্র তুলে ধরা হয় অনুষ্ঠানের শুরুতে। যেখানে উঠে আসে প্রয়াত বরেণ্য গুণীজনদের এই সাহিত্যপত্রিকাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অনেক স্মৃতিকথা। মোড়ক উন্মোচন হয় পত্রিকাটির বিংশতিতম বিশেষ সংখ্যার। এ সংখ্যার প্রচ্ছদটি করা হয়েছে প্রয়াত বরেণ্য শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর আঁকা ছবি দিয়ে।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেখক, গবেষক, শিক্ষক এবং কথাসাহিত্যিকসহ দেশের অনেক গুণীজন। ৮, ৯ ও ১০ ফেব্রুয়ারি তিন দিনের এ সাহিত্য সম্মেলনে মোট সাতটি অধিবেশনে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতির নানা বিষয়ে আলোকপাত করে আলোচনা হবে।