নারী নির্যাতন মামলার অর্ধেকই ধর্ষণের

চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়, যার মধ্যে ৩ হাজার ৫২৩টি ধর্ষণের।

চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে দেশে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলার প্রায় অর্ধেক ধর্ষণের। পাঁচ বছর ধরে ধর্ষণের মামলার হার বেড়েই চলছে। আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাব, বিচারপ্রক্রিয়ার দুর্বলতা, দীর্ঘসূত্রতা এবং দোষীদের বিচার না হওয়ার সংস্কৃতির কারণে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব বলছে, এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ৭ হাজার ৩৫০টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৫২৩টি।

এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘ধর্ষণ একটি সামাজিক সমস্যা। এর পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ধর্ষণ প্রতিরোধে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি। পুলিশ অবহেলা করলে আমরা তাদেরও ছাড়ি না। আমি মনে করি, সমাজ এগিয়ে না এলে ধর্ষণ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’

গণমাধ্যমের খবর ও মামলার অভিযোগ থেকে দেখা যাচ্ছে, দেশে বিভিন্ন মাত্রায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। ২ আগস্ট কুষ্টিয়া থেকে নারায়ণগঞ্জগামী যাত্রীবাহী বাস টাঙ্গাইলের মধুপুর এলাকায় ডাকাতির কবলে পড়ে। ওই সময় এক নারী যাত্রী দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন। ডাকাতির ঘটনায় একমাত্র ওই নারী যাত্রীই প্রতিবাদ করেছিলেন। চলন্ত বাসে ধর্ষণ ও হত্যার বেশ কয়েকটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটলেও যাত্রীভর্তি বাসে এভাবে ধর্ষণের ঘটনার কথা আগে শোনা যায়নি।

এ ঘটনার মাত্র চার দিন পর ৬ আগস্ট গাজীপুরের শ্রীপুরে তাকওয়া পরিবহনের মিনিবাসে দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ। এর আগে ধর্ষকেরা সঙ্গে থাকা তাঁর স্বামীকে বাস থেকে ফেলে দেয়। সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার কক্সবাজার সদর উপজেলায় রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে এক স্কুলশিক্ষিকাকে (২৫) দলবদ্ধ ধর্ষণের খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়।

জানা যায়, ১৯ আগস্ট সকাল সাড়ে সাতটার দিকে ব্যাটারিচালিত ইজিবাইকে (টমটম) বাড়ি ফিরছিলেন ওই শিক্ষিকা। পথে ইজিবাইকের গতিরোধ করে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তিন ব্যক্তি তাঁকে ধর্ষণ করে। একই দিন ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ উপজেলায় সাত বছর বয়সী সন্তানের গলায় ছুরি ধরে এক গৃহবধূকে ধর্ষণ করে ইজিবাইকের চালক ও চার যাত্রী।

আমি মনে করি, সমাজ এগিয়ে না এলে ধর্ষণ শতভাগ প্রতিরোধ করা সম্ভব নয়।’
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

ধর্ষণের উদ্বেগজনক এমন পরিস্থিতিতে আজ বুধবার দেশে ‘নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হচ্ছে। ২৭ বছর আগে ধর্ষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদের প্রতীক হিসেবে দিবসটি পালন শুরু করেন নারী ও মানবাধিকারকর্মীরা। ১৯৯৫ সালের এ দিনে (২৪ আগস্ট) ঢাকা থেকে দিনাজপুরে বাড়িতে যাওয়ার পথে কিশোরী ইয়াসমিন (১৩) পুলিশের হাতে দলবদ্ধ ধর্ষণ ও হত্যার শিকার হয়। এ ঘটনার বিচারের দাবিতে দিনাজপুরসহ সারা দেশে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়। ২০০৪ সালে ঘটনায় জড়িত তিন পুলিশ সদস্যের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়।

নির্যাতন ও ধর্ষণ বাড়ছে

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৮ সালের তুলনায় চলতি বছর ধর্ষণের মামলা ১০ শতাংশ বেড়েছে। ২০১৮ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১০ হাজার ৪০৮টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলা ছিল ৩৮ শতাংশ। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪৩ শতাংশ, ২০২০ সালে প্রায় ৪৮ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৪৯ শতাংশ মামলা ছিল ধর্ষণের। চলতি বছরের প্রথম ৭ মাসে এই হার ৪৮।

জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এর তথ্য অনুযায়ী, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে কলের সংখ্যা ব্যাপক হারে বাড়ছে। এ বছরের জুলাই পর্যন্ত নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে ১১ হাজার ৯৫৯টি কল এসেছে। এর মধ্যে ধর্ষণের ৬১৯, ধর্ষণচেষ্টা ৩১৪, যৌন নির্যাতন ২৬৮, ধর্ষণের হুমকি ৩১ এবং উত্ত্যক্ত ও যৌন হয়রানির ১ হাজার ৯টি অভিযোগ রয়েছে। একই অভিযোগে ২০২১ সালে ১২ হাজার ১৬৯, ২০২০ সালে ৬ হাজার ৩৩১, ২০১৯ সালে ৩ হাজার ১১৫ এবং ২০১৮ সালে ২ হাজার ২৯২টি কল আসে।

অবশ্য ৯৯৯-এর ফোকাল পারসন (গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) পুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার সাত্তার বলেন, কলের সংখ্যা বাড়ার মানে এই হারে নির্যাতন বেড়েছে তা নয়। ৯৯৯ নম্বরে কল করলে প্রতিকার পাওয়া যায় বলে কল বেড়েছে।

ধর্ষণের বিরুদ্ধে সারা দেশে আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০২০ সালের ১৩ অক্টোবর ধর্ষণের সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড করে সরকার। তবে এখনো এই আইনের কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান খন্দকার ফারজানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, অনেক পুরুষ নিজেদের ক্ষমতা প্রদর্শনের উপায় হিসেবে ধর্ষণের মতো ঘটনা ঘটায়। দেশের সমাজব্যবস্থায় একজন নারীর ‘সতীত্ব’কে এতটাই গুরুত্ব দেওয়া হয় যে নারীকে হেয় করার প্রয়োজন হলেও ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়। কিছু মানুষের মধ্যে যৌন বিকৃতি আছে। তাঁর মতে, পরিবারে ছেলেমেয়েকে সমান চোখে দেখা এবং বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে অপরাধীদের দ্রুত সাজার আওতায় আনা গেলে ধর্ষণের ঘটনা কমবে।

ধর্ষণের নানা মাত্রা

গত বছরের মে মাসে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বেঙ্গালুরুতে এক বাংলাদেশি তরুণী (২২) দলবদ্ধ ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হন। ওই ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় ভারতের আদালতে সাজাপ্রাপ্ত ১১ জনের মধ্যে যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ৭ জন বাংলাদেশি। দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের একজন মোহাম্মদ রিফাদুল ইসলাম ওরফে হৃদয় বাবু ওরফে টিকটক হৃদয় প্রেমের ফাঁদে ফেলে ওই তরুণীকে ভারতে পাচার করেন।

ওই তরুণীকে দেশে ফিরিয়ে আনার পর তিন দিন ঢাকার তেজগাঁও থানা প্রাঙ্গণে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে রাখা হয়। সেন্টারের এক পুলিশ কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে টিকটক মডেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে প্রেমের সম্পর্কে জড়ানো হয়। পরে এই তরুণীর মতো অনেকে ধর্ষণের শিকার হয়। কম বয়সী মেয়েরা অসচেতনতার কারণে খুব সহজে এসব প্রতারণার ফাঁদে পড়ে।

ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারের তথ্য অনুসারে, নারী ও শিশু নির্যাতনের অভিযোগে সেখানে ১৪২টি মামলা আছে। এর মধ্যে দুটি দলবদ্ধসহ মোট ধর্ষণের মামলা ৬৩টি। অর্থাৎ মোট মামলার ৪৪ শতাংশ ধর্ষণের মামলা।

এ বছর আরও কয়েকটি আলোচিত ঘটনার একটি হচ্ছে স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণ। গত ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নরসিংদীর ঘোড়াশাল ফ্ল্যাগ স্টেশন এলাকায় স্বামী-স্ত্রী ঘুরতে গেলে তিন বখাটে তাঁদের উত্ত্যক্ত করে। একপর্যায়ে বখাটেরা স্বামীকে মারধর করে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণ করে।

২০১৭ থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত ধর্ষণের সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, স্বামীর কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বা স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ১৫টি। এ ছাড়া মা-বাবাকে বেঁধে একটি ও সন্তানদের জিম্মি করে মাকে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে পাঁচটি।

স্বামীর কাছ থেকে স্ত্রীকে ছিনিয়ে নিয়ে ধর্ষণের ১৫টি ঘটনা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রতিটি ঘটনার ধরন এক। দল বেঁধে প্রথমে বখাটেরা দম্পতির সঙ্গে তর্কাতর্কি করে বা চাঁদা দাবি করে ‘ঝামেলা’ পাকায়। এভাবে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ধর্ষণ করে।

ধর্ষণের উদ্বেগজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণ এখন উদ্বেগজনক পর্যায়ে চলে গেছে। দ্রুত আইন প্রয়োগ এবং প্রকৃত দোষীদের খুঁজে বের করা গেলে নারীদের প্রতি অপরাধের বিরুদ্ধে শক্ত বার্তা দেওয়া যেত। কিন্তু দেখা যায়, নারীদের উল্টো কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। আইনের শাসন নিশ্চিত না করে কেবল সর্বোচ্চ সাজার বিধান রেখে ধর্ষণ কমানো সম্ভব নয়।

মিজানুর রহমান বলেন, নারী নির্যাতন ও ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার কথা, সেটাও দেখা যাচ্ছে না। এ ধরনের অপরাধ প্রতিরোধে দৃশ্যমান রাজনৈতিক সদিচ্ছাও দরকার।