মৃত্যুঝুঁকি বাড়াচ্ছে নিম্নমানের হেলমেট

জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ উপলক্ষে বাংলাদেশে মানসম্মত মোটরসাইকেল হেলমেট নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও ব্র্যাকের যৌথ আলোচনা সভা
ছবি: প্রথম আলো

দেশের বাজারে অধিকাংশ হেলমেট মানহীন। বাড়তি আমদানি শুল্কের কারণে দাম বেশি হওয়ায় ভালো মানের হেলমেট ব্যবহারে ক্রেতাদের আগ্রহ কম। এ ছাড়া বাজারে যেসব হেলমেট পাওয়া যায়, দেখে বোঝার কোনো উপায় নেই সেগুলো মানসম্মত কি না। অথচ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও ঝুঁকি কমাতে ভালো মানের হেলমেট ব্যবহার করার বিকল্প নেই।

জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ-২০২৩ উপলক্ষে রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ব্র্যাক ও বিশ্বব্যাংক আয়োজিত আলোচনা সভায় এসব কথা বলেন আলোচকেরা।

সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, মোটরসাইকেল ব্যবহার সীমিত করা নয়, আরোহীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। মানহীন হেলমেটের ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। এ জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

সরকারের একার পক্ষে মোটরসাইকেল আরোহীদের মানসম্মত হেলমেট ব্যবহারের আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করা সম্ভব নয় উল্লেখ করে আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে আমাদের একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।’

সভার বিশেষ অতিথি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, দেশে মোট দুর্ঘটনার ৪০ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা। ঝুঁকিপূর্ণভাবে মোটরসাইকেল চালানো এসব দুর্ঘটনার প্রধান কারণ। আবার হেলমেট একেবারেই না পরা বা ভালো মানের হেলমেট না পরার কারণে দুর্ঘটনার ফলও হয় মারাত্মক।

সড়ক নিরাপত্তা আইন-২০১৮ অনুযায়ী মোটরসাইকেল আরোহীর মানসম্মত হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক। কিন্তু এ নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো মান ছিল না। তবে বিএসটিআই নিরাপদ হেলমেটের মান চূড়ান্ত করেছে। গত বছরের অক্টোবরে সরকার এ বিষয়ে গেজেট প্রকাশ করেছে। এই গেজেট প্রকাশের পর মোটরসাইকেল হেলমেট বিক্রি ও পরিধানের ক্ষেত্রে এই মান মেনে চলা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ কারণে আমদানি করা হেলমেটের বিএসটিআইয়ের ছাড়পত্র থাকা বাধ্যতামূলক।

আমদানি শুল্ক বেশি প্রসঙ্গে বিএসটিআইয়ের মহাপরিচালক মো. আবদুস সাত্তার বলেন, বাজারে ৩ হাজার থেকে শুরু করে ৭০ হাজার টাকায় ভালো মানের হেলমেট পাওয়া যায়। তবে এসব হেলমেটেরও আয়ুষ্কাল থাকা প্রয়োজন। কত দিন ব্যবহার করা যাবে, সেটা ঠিক করা দরকার। হেলমেট কেনার সময় বিএসটিআইয়ের স্টিকার দেখে কেনার পরামর্শ দেন তিনি।

দেশে ভালো মানের হেলমেট উৎপাদনের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে বলেও জানান আবদুস সাত্তার। তিনি বলেন, প্রাণ গ্রুপ হেলেমট উৎপাদনের অনুমতি পেয়েছে। তারা প্রথমে যে মানের হেলমেট উৎপাদনের জন্য নমুনা দিয়েছিল, সেসব বিএসটিআইয়ের নির্ধারিত মানের ছিল না। নির্ধারিত মানের হেলমেটের নমুনা পাঠানোর পর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

সভার বিশেষ অতিথি পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘গত কয়েক বছরে আমরা হত্যাকাণ্ডের মতো অপরাধের হারও কমাতে সক্ষম হয়েছি। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা এবং এ থেকে মৃত্যুর হার কমানো সম্ভব হয়নি এখনো।’

বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদুল্লায়ে সেক বলেন, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের অধিকাংশের বয়স ২৬ থেকে ৩০ বছর। দুঃখজনকভাবে বাংলাদেশের বাজারে বর্তমানে যেসব হেলমেট পাওয়া যায়, তার অধিকাংশই গুণগত মান ও সুরক্ষা—কোনো দিক থেকেই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড পূরণ করে না।

ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্বব্যাংকের আন্তর্জাতিক পরামর্শক পিয়েরে ক্যাসটাইং বলেন, বাংলাদেশ সরকার হেলমেটের মানদণ্ড নির্ধারণ ও চালকদের হেলমেট ব্যবহার বাধ্যতামূলক করে আইন করেছে। এখন এই আইনের কার্যকর প্রয়োগের পদক্ষেপ নিতে হবে।

অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন বিশ্বব্যাংকের জ্যেষ্ঠ পরিবহনবিশেষজ্ঞ এবং প্রতিষ্ঠানটির অর্থায়নে বাস্তবায়িত বাংলাদেশ রোড সেফটি প্রকল্পের প্রধান দীপন বোস। তিনি বলেন, বিশ্বব্যাংক সড়ক নিরাপত্তাকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন অগ্রাধিকার মনে করে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে তাঁরা অঙ্গীকারবদ্ধ।

সভার সঞ্চালক ব্র্যাকের রোড সেফটি প্রোগ্রামের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন বলেন, আইন মেনে চলা এবং আইনের প্রয়োগ উভয় ক্ষেত্রেই জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। সুবিধা উপলব্ধি করলে মানুষ আইন মানতে উৎসাহী হন।

সমাপনী বক্তব্যে বিশ্বব্যাংকের কর্মসূচি সমন্বয়ক দিলশাদ দোসানি বলেন, বাংলাদেশে হেলমেট নিয়ে জাতীয় নিরাপত্তা মানদণ্ড বাস্তবায়নে সরকার এবং অন্যান্য বেসরকারি সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এ কমিটি একটি রোডম্যাপ প্রণয়ন করবে, যার আওতায় আইনটি বাস্তবায়নে একটি কর্মপরিকল্পনা ও কর্মকৌশল প্রণয়ন করা হবে।

বিশ্বজুড়ে পালিত হচ্ছে সপ্তম জাতিসংঘ সড়ক নিরাপত্তা সপ্তাহ। এ বছর ১৫ থেকে ২১ মে সপ্তাহটি পালন করা হয়েছে।