নির্বাচন সুষ্ঠু করতে ১৪ বাধা

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে নিজেদের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠভাবে করার ক্ষেত্রে ১৪ ধরনের চ্যালেঞ্জ বা বাধা দেখছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এর প্রথমটিই হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থাহীনতা। বিএনপিসহ সরকারবিরোধী দলগুলো শুরু থেকেই বর্তমান নির্বাচন কমিশনের প্রতি তাদের অনাস্থার কথা বলে আসছে। এখন ইসিও মনে করে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য কমিশনের প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা থাকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

নির্বাচনের সময় পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা কতটা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারবে—এটি এখন ইসির দ্বিতীয় চিন্তা। আর নির্বাচনে ইভিএমের (ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন) প্রতি বেশিরভাগ দলের অনাস্থা ভোট সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে তৃতীয় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিশন।

গতকাল বুধবার সকালে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মপরিকল্পনা’ প্রকাশ করেছে ইসি। তাতে ওই তিনটি বিষয়ের বাইরেও ইসি যেসব প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে রয়েছে অর্থ ও পেশিশক্তির নিয়ন্ত্রণ; নির্বাচনের সময় আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা; সব দলের নির্বাচনী আচরণবিধি অনুসরণ; প্রার্থীদের নির্বিঘ্ন প্রচার; জাল ভোট বা ভোটকেন্দ্র দখল বা ব্যালট ছিনতাই রোধ; প্রার্থী বা এজেন্ট বা ভোটারদের অবাধে ভোটকেন্দ্র আসা; ভোটারদের পছন্দ অনুযায়ী ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি; নির্বাচন–সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ প্রদান; পর্যাপ্তসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য নিয়োগ; পর্যাপ্তসংখ্যক নির্বাহী ও বিচারিক হাকিম নিয়োগ এবং নিরপেক্ষ দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষকের ব্যবস্থা রাখা। এসব প্রতিবন্ধকতা উত্তরণে ১৯টি উপায়ের কথাও বলেছে ইসি।

তবে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসি কীভাবে আস্থার সংকট কাটাবে, ইভিএমে আস্থা আনবে, পুলিশ–প্রশাসনকে নিয়ন্ত্রণে রাখবে, নির্বাচনের সময় হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করবে, এজেন্টদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে—কর্মপরিকল্পনায় এসব প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট কোনো উত্তর নেই। ইসির কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, বড় প্রতিবন্ধকতাগুলো উত্তরণে অনেক ক্ষেত্রে সরকারের দিকেই তাদের তাকিয়ে থাকতে হবে।

কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ অনুষ্ঠানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল উপস্থিত ছিলেন না। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, অসুস্থতার কারণে তিনি থাকতে পারেননি। তাঁর অনুপস্থিতিতে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন।

অবশ্য কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের পরপরই তা খারিজ করে দিয়েছে বিএনপি ও জাতীয় পার্টি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেছেন, এই নির্বাচন কমিশন তাঁরা মানেন না। তাই এই কর্মপরিকল্পনা নিয়েও তাঁদের কোনো বক্তব্য নেই।

অন্যদিকে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মো. মুজিবুল হক বলেন, ইসির কর্মপরিকল্পনা মূল্যহীন। যে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা নেই, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন করতে পারবে বলে মনে হয় না।

ইসির পাঁচ লক্ষ্য

ইসি বলেছে, আগামী বছরের ডিসেম্বরের শেষে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। কর্মপরিকল্পনায় নির্বাচনের পাঁচটি লক্ষ্যের কথা বলেছে ইসি। সেগুলো হলো অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও সুষ্ঠু নির্বাচন। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যাখ্যায় কমিশন বলেছে, ‘ইচ্ছুক সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সক্রিয় অংশগ্রহণ।’

‘স্বচ্ছ’–এর ব্যাখ্যায় ইসি বলেছে, তাদের সব কার্যক্রম ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে, পর্যাপ্তসংখ্যক দেশি–বিদেশি পর্যবেক্ষক নিয়োগ এবং সংবাদকর্মীদের অবাধে সংবাদ সংগ্রহের সুযোগ দেওয়া হবে। আর গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যাখ্যায় তারা বলেছে, নির্বাচনের ফলাফল সব ভোটার ও অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের কাজে গ্রহণযোগ্য প্রতীয়মান হওয়া।

কর্মপরিকল্পনার প্রথমেই ইসি বলেছে ‘নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দলগুলোর সরকার ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি আস্থা সৃষ্টি’ করা। তবে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করতে বিশেষ কোনো উদ্যোগের কথা বলেনি তারা। কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে অনাস্থা কেটে যাবে বলে মনে করে ইসি।

নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, ‘আমরা অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন। আমরা অনেক আস্থাশীলতার ঘাটতির মধ্যে আছি। আমি মনে করি, আমাদের কর্মকাণ্ড দিয়ে প্রমাণ দিয়েছি, আমরা কিছুটা হলেও আগে থেকে আস্থা অর্জনে এগিয়ে গিয়েছি।’

ইসি শুরু থেকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বলে আসছে। কিন্তু অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি বলছে, ইসির প্রতি তাদের আস্থা নেই। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর গতকালের অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, নির্বাচনের আরও এক বছর চার মাস বাকি। তাঁরা যে কর্মপরিকল্পনা তৈরি করেছেন, তা বাস্তবায়ন করতে পারলে অনাস্থা কেটে যাবে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে অনেক সময় অনেক দল নির্বাচনে অংশ নেয় না। কোনো দল না এলে কমিশন কী করতে পারে?

আর নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেন, ইচ্ছা না থাকলে কাউকে জোর করে কিছু খাওয়ানো যাবে না। এ জন্য ইচ্ছা থাকতে হবে।

ইভিএম নিয়ে বিপরীতমুখী বক্তব্য

জাতীয় নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছে ইসি। এখন তারা বলছে, যন্ত্রটির প্রতি রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা সৃষ্টি করতে হবে। কোন প্রক্রিয়ায় ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা নিয়ে বিপরীতমুখী বক্তব্য এসেছে ইসির কাছ থেকে। এর আগে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছিলেন, ইসি নিজস্ব বিবেচনায় ইভিএম ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত মুখ্য বিবেচনায় ছিল না।

নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় ইসি দাবি করেছে, গত জুলাইয়ে অংশ নেওয়া সংলাপে ২৯টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ১৭টি দল ইভিএমের পক্ষে বলেছে, ১২টি দল বিপক্ষে। বেশির ভাগ দলের মত ইভিএমের পক্ষে থাকায় এটি ব্যবহার না করা যুক্তিসংগত হবে না বলে মনে করে কমিশন। তাই কমিশন উভয় পক্ষের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ ১৫০টি আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যুক্তিসংগত মনে করে। যদিও সংলাপের শেষ দিন সিইসি নিজে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে বলেছিলেন, ‘অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমে বিশ্বাস করছে না।’

কর্মপরিকল্পনায় ইসি বলেছে, ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশন ও জেলা সদরের আসনগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ইভিএম নিয়ে রাজনৈতিক মতানৈক্যের কথা তুলে ধরে যন্ত্রটির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরা হয় কর্মপরিকল্পনায়। তাতে বলা হয়, বায়োমেট্রিক (যে বৈশিষ্ট্যের জন্য কাউকে শনাক্ত করা হয় সেই পদ্ধতি) যাচাই করে ভোট দেওয়ার পদ্ধতি থাকায় জাল ভোট দেওয়ার সুযোগ নেই। ইভিএমে একজন ভোটার একাধিকবার ভোট দিতে পারে না।

ইভিএমে কারচুপি হয়—অভিযোগটি শুধু মনস্তাত্ত্বিক ধারণা থেকে করা হয় বলে দাবি ইসির। তারা বলেছে, এ বিষয়ে ইসির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময় প্রমাণ করার জন্য বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে আহ্বান করা হয়েছে। কিন্তু তারা কেউ অভিযোগটি প্রমাণ করতে পারেনি।

ইসি বলছে, ব্যালটে ভোট হলে কেন্দ্র দখল করে কারচুপি হয়। তাহলে যে ১৫০ আসনে ব্যালটে ভোট হবে সেগুলো নিয়ে শঙ্কা থেকে যায় কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, যে আসনগুলোতে ইভিএমে হবে সেগুলো নিরাপদ করা হলো। বাকি আসনে ফোর্স (আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত সদস্য) বেশি খাটানো যাবে। ইসির হাতে তিন–চার বছর সময় থাকলে ৩০০ আসনেই ইভিএমে ভোট করা হতো। ৩০০ আসনে ব্যালটে ভোট হলে ‘রিস্ক’ (ঝুঁকি) অবশ্যই বেশি। এমনও হতে পারে, সে ক্ষেত্রে একাধিক দিনে ভোট করা হবে।

পুলিশ–প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ

নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনকে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বা প্রতিবন্ধক বলে মনে করছে ইসি। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে দেখা গেছে, পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি ইসি। ওই সব নির্বাচনের আগেও ইসি বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছিল। ইসি এবার কীভাবে পুলিশ ও প্রশাসনের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেন, কারও বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ দায়িত্ব পালনে অনীহা ও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ প্রমাণিত হলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ভোটের সময় ইসি পুলিশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবে, নাকি আগের মতো আরেকটি নির্বাচন হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে মো. আলমগীর বলেন, ‘সরকার, পুলিশ আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকবে, সেটাই বলা হয়েছে। আমরা এ কথাও বলেছি, আমরা যদি দেখি আমাদের দায়িত্ব আমরা সঠিকভাবে পালন করতে পারছি না, যে মুহূর্তে থেকে, সে মুহূর্তে আমরা দায়িত্ব পালন করব না।’

নির্বাচনের আগে হয়রানিমূলক মামলা করা হবে না, ইসি এই নিশ্চয়তা দিচ্ছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেন, যে পরিস্থিতি ইসি সৃষ্টি করতে চায়, সবার সহযোগিতা পেলে, সে রকম পরিবেশ হলে হয়রানিমূলক মামলা হবে না।

সাত করণীয়

ইসির কর্মপরিকল্পনায় আগামী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে আরও সাতটি করণীয় উল্লেখ করা হয়েছে। সেগুলো হলো সংসদীয় এলাকার সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও সরবরাহ, বিধিবিধান অনুযায়ী ভোটকেন্দ্র স্থাপন, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও নিবন্ধিত দলের নিরীক্ষা, সংশ্লিষ্টদের সক্ষমতা বৃদ্ধি, নির্বাচনে অধিকতর প্রযুক্তির ব্যবহার এবং পর্যবেক্ষক সংস্থা নিবন্ধন ও নবায়ন কার্যক্রম। এই কাজগুলো কখন, কীভাবে করা হবে, তার একটি রূপরেখা কর্মপরিকল্পনায় দেওয়া হয়েছে।

ইসির কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, ইসি কীভাবে আস্থার সংকট কাটাবে, তার জন্য একটি রোডম্যাপ (পথনকশা) দরকার। তারা জনমত উপেক্ষা করে বলছে, ইভিএমে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব। তাদের উচিত এখনই ইভিএম পরিহার করা। তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে, তার ওপর নির্ভর করে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা কেমন হবে। দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি। এখন থেকেই বিরোধী দলের ওপর যেভাবে দমন–পীড়ন হচ্ছে, তাতে তারা নির্বাচনেই যেতে পারবে না। মৌলিক সমস্যা সমাধান না করে ইসি যে কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করেছে, তা একটি ব্যর্থ নির্বাচনের দিকে নিয়ে যাবে দেশকে।