সন্তান জন্মের আনন্দ মিলিয়ে গেল মায়ের অসুস্থতায়

আজিম উদ্দিন তালুকদার ও সুমাইয়া তারিনের কোল আলো করে এসেছে কন্যা সন্তান। কিন্তু প্রথম সন্তান জন্মের আনন্দ নেই পরিবারে। অস্ত্রোপচার পরবর্তী জটিলতায় মা সুমাইয়া এখন লড়ছেন চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে। সেখানেই আজ সকালে এক স্বজনের কোলে নবজাতকটিপ্রথম আলো

প্রথম সন্তান জন্ম নেবে তার জন্য কত প্রস্তুতি পরিবারটিতে। হাসপাতালে যাতে দ্রুত ভর্তি করানো যায়, সে জন্য ১৫ দিন আগেই স্ত্রীকে গ্রাম থেকে শহরে নিয়ে রেখেছিলেন আজিম উদ্দিন তালুকদার। ছিলেন ষোলোশহর এলাকার আত্মীয়ের বাসায়। ১৭ মার্চ ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে স্ত্রী সুমাইয়া তারিন (১৯) একটি কন্যাসন্তান প্রসব করেন। স্বামী–স্ত্রী দুজনেই প্রথম সন্তানের মুখ দেখে খুশি হন।

কিন্তু তাঁদের এই খুশি স্থায়ী হয়নি। রাত থেকেই সুমাইয়ার অবস্থা খারাপ হতে থাকে। শ্বাসকষ্ট, প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যাওয়াসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। একপর্যায়ে তাঁর জীবন সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। ওই অবস্থায় ১৮ মার্চ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আর দায়িত্ব নেয়নি বলে অভিযোগ। সুমাইয়াকে উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। ওই দিনই বেসরকারি পার্ক ভিউ হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাঁকে। তখন থেকেই চলছে সুমাইয়ার প্রাণ বাঁচানোর যুদ্ধ।

আজিম উদ্দিন তালুকদারের বাড়ি রাউজানের নোয়াপাড়া এলাকায়। তিনি ছোট একটা ব্যবসা করেন। আয়রোজগার কম। বাড়িতেই থাকেন। স্বল্প আয়ের মধ্যেও প্রথম সন্তানের পৃথিবীর আলো দেখার ক্ষণটি নির্বিঘ্ন করতে সাধ্যমতো চেষ্টা করেছিলেন। এখন একদিকে তাঁর স্ত্রী সংকটে, অন্যদিকে চিকিৎসা খরচ মেটাতে হিমশিম খাচ্ছেন আজিম। সুমাইয়ার দুটি কিডনি বিকল হয়ে পড়েছে। এখন ডায়ালাইসিস চলছে।

আজিম উদ্দিন বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালে অপারেশন করেছিলেন কোহিনুর আকতার নামের একজন। অস্ত্রোপচারের পর ভালো ছিল কিছুক্ষণ। কিন্তু রাত থেকে তাঁর অবস্থা খারাপ হলেও তারা কোনো দায়িত্ব নেয়নি। পরদিন একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে অন্য জায়গায় নিয়ে যেতে বলে। তারা শেষ করে দিয়েছে আমার স্ত্রীর জীবন।’

১৮ মার্চ থেকে পার্কভিউ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সুমাইয়া। প্রথমে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ছিলেন তিনি। এরপর তাঁকে কেবিনে দেওয়া হয়। কিন্তু তাঁর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেছে। তাঁর হাত, পা, মুখ ফুলে গেছে। তাঁর খুব কষ্টে দিন কাটছে। নবজাতক বুকের দুধও পাচ্ছে না।

অসুস্থ সুমাইয়া বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের দিন থেকে কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের কেউ দেখেনি। সকালে এক নার্স এসে যখন আমার শরীরের রং পরিবর্তন হয়ে গেছে দেখেছে, তখন দৌড় দেয়। এরপর ডাক্তাররা এসে নানা পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছিল। পরে এখানে পাঠিয়ে দেয়।’

পার্কভিউ হাসপাতালে ভর্তির পর নিশ্চিত হওয়া যায়, সুমাইয়ার দুটো কিডনি বিকল হয়ে গেছে। এরপর সপ্তাহে তিন দিন তাঁর ডায়ালাইসিস চালানো হয়। এখনো তাঁর অবস্থার তেমন উন্নতি হয়নি। শনিবার রাতে সামান্য প্রস্রাব হলেও এখনো কিডনি কাজ করছে না। তাঁকে দেখছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক রফিকুল হাসান।

রফিকুল হাসান বলেন, ‘আশা করছি ধীরে ধীরে কিডনি কাজ শুরু করবে। তবে সময় লাগছে। অস্ত্রোপচারের পর থেকে সংক্রমণ কিংবা অন্য কোনো কারণে এ রকম হতে পারে।’

সন্তান হওয়ার আনন্দ মিলিয়ে গেছে পরিবারটির। আজ সকালে হাসপাতালের কেবিনে গিয়ে দেখা যায়, নবজাতকটিকে এক আত্মীয় টিকা দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। আজিম উদ্দিন পেছন পেছন ছুটছেন।

আজিম বলেন, ‘মেয়ে হওয়ায় আমরা খুশি ছিলাম। কিন্তু তার মাকে কীভাবে বাঁচাব, সেটাই এখন ভাবছি। এ পর্যন্ত আমার দুই লাখ টাকা খরচ হয়ে গেছে। হাসপাতালের বিল রয়েছে আরও দুই লাখের বেশি। কত দিন এখানে থাকতে হয়, তা–ও বলতে পারছি না। ধারদেনা করে চলছি। আমি ইন্টারন্যাশনাল হাসপাতালের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেব।’

উল্লেখ্য, সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে অস্ত্রোপচারের পর চট্টগ্রামে আট মায়ের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ইন্টারন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই চারজন মারা যান। এ ছাড়া ওই হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা আরও কয়েকজন রোগী বিভিন্ন হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা নিচ্ছেন। তাঁদের একজন সুমাইয়া তারিন। এ বিষয়ে হাসপাতালটির সঙ্গে যোগাযোগ করেও বক্তব্য পাওয়া যায়নি।