স্নিগ্ধ সৌম্য শরতের অর্কিড 

খুলনা শহরে ছাদবাগানে ফোটা ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড
ছবি: লেখক

গ্রিক পুরাণে অর্কিস হলো সমুদ্র পরি নিম্ফ ও বনদেবতা স্যাটারের পুত্র। সে ভালোবেসেছিল সুরার দেবতা ব্যাক্কাসের প্রাসাদের এক সুন্দরী কুমারীকে। ব্যাক্কাস রেগে অর্কিসকে কেটে টুকরা টুকরা করে এদিক-ওদিক ছিটিয়ে ফেলে দেয়। হতভাগা অর্কিসের দেহের টুকরা যেখানেই পড়ে, সেখানেই এক একটা উদ্ভিদের জন্ম হয়। সেসব উদ্ভিদ অন্য সব উদ্ভিদের চেয়ে আলাদা। সেসব গাছের মতো ফুল পৃথিবীর আর কোনো গাছে ফোটে না। তাই সেসব গাছের নাম রাখা হয় অর্কিসের নামের সঙ্গে মিল রেখে ‘অর্কিড’। 

অর্কিড ফুল ফোটে প্রধানত শীত-বসন্তে। কিন্তু খুলনায় শরতেই ফুটেছে বেশ কয়েক রকমের অর্কিড ফুল। প্রকৃতিপ্রেমী শেখ আবদুল্লাহ আল মামুন পেশায় ডেন্টাল সার্জন হলেও নেশায় তিনি পরম মমতা দিয়ে সামছুর রহমান রোডে তাঁর বাড়িতে গড়ে তুলেছেন এক চমৎকার ছাদবাগান। সে বাগানে শরতে ফুটেছে পাঁচ রকমের অর্কিড ফুল। নানা রঙের সেসব অর্কিড ফুল অন্যান্য ফুলের সঙ্গে মিলেমিশে ছাদকে করেছে আলোকিত। তাঁর ফেসবুকে অর্কিড ফুলগুলোর ছবি দেখেই শরতের এক বিকেলে তাঁর ছাদবাগানে গিয়ে হাজির হলাম। আহা কী স্নিগ্ধ সৌম্য বৃষ্টিস্নাত পবিত্র সে ফুল! সেগুলো ফুটছে বর্ষার শেষ থেকে, থাকবে শরতের শেষ অবধি—জানালেন তিনি। অর্কিড ফুলের এই এক মজা। অন্য ফুলগুলো যেখানে দিনের ফুল দিনেই ঝরে যায়, সেখানে অর্কিড ফুল একবার ফুটলে থাকে কয়েক সপ্তাহ।

ছাদে উঠে প্রথমে গেলাম একটা গোলাপি ফুলের অর্কিডের কাছে, ফুলের পাপড়িগুলো গোলাপি হলেও জিহ্বায় ঘন ম্যাজেন্টা রঙের আভা। ফুলে কোনো ঘ্রাণ নেই। বললেন, ওটা মিনি ডেনড্রোবিয়াম অর্কিড (Dendrobium bigibbum)। তাঁর পরামর্শ হলো, যাঁরা অর্কিড বাগান শুরু করতে চান, তাঁরা যেন এটা দিয়ে শুরু করেন। কেননা, এই অর্কিডগাছ সহজে পাওয়া যায়, আমাদের পরিবেশ ও আবহাওয়ার সঙ্গে চমৎকার মানায় এবং সহজে নিজেরাই এর চারা তৈরি করা যায়। খুলনায় এর ফুল ফোটে জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। তবে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে আবহাওয়ার কারণে ফুল ফোটার সময় একটু আগে-পরে হতে পারে। এর ইংরেজি নাম কুকটাউন অর্কিড। অস্ট্রেলিয়া ও পাপুয়া নিউগিনিতে এর জন্ম হলেও এ দেশে এখন এই অর্কিড দিব্যি মানিয়ে গেছে। প্রাকৃতিক পরিবেশে বনের আধা পাতাঝরা গাছের ওপর জন্মালেও সে এখন লালিত। গ্রিক শব্দ ডেনড্রোস মানে বৃক্ষ, আর বায়োস মানে জীবন—এ দুটি শব্দ থেকেই এই অর্কিডের নাম রাখা হয়েছে ডেনড্রোবিয়াম, যা আসলে গাছের ওপর পরগাছা হিসেবেই জন্মে। 

শরতে ফোটা ব্রাসোক্যাটলেয়া অর্কিড
ছবি: লেখক

এরপর দেখা হলো শরতে ফোটা এনসিভোলা ও লিপলেস মিনি ডেনড্রোবিয়াম অর্কিডের সঙ্গে। দেখা হলো পুরোপুরি ম্যাজেন্টা রঙের আর এক ডেনড্রোবিয়াম অর্কিডের সঙ্গে। তবে ব্রাসোক্যাটলেয়া (Brassocattleya sp) অর্কিডের ফুলগুলো অন্য রকম। এ ফুলের পাঁচটি পাপড়ি জিহ্বার চেয়ে ছোট, পাপড়ি ও জিহ্বা হলদে ও কমলা আভা যেন গোধূলির আকাশ রচনা করেছে। অপূর্ব সুন্দর সে। বললেন ওটা হাইব্রিড অর্কিড। তিনি ২০০৮ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে কোনো এক সময় ওটা সংগ্রহ করেছিলেন থাইল্যান্ড থেকে। তাঁর ছাদবাগানে প্রায় ২০ রকমের অর্কিড আছে। সেগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন অনলাইনে, বৃক্ষমেলা থেকে ও অর্কিডপ্রেমীদের সঙ্গে চারা বিনিময়ের মাধ্যমে। দেশের বাগানেও অনেক অর্কিড আছে। দেশি অর্কিডগুলো তিনি সংগ্রহ করেছেন সিলেট থেকে। 

অর্কিড বাগান করতে গিয়ে তাঁর বিচিত্র সব অভিজ্ঞতা হয়েছে। পরামর্শ, সাহচর্য ও সহযোগিতা পেয়েছেন বেশ কিছু অর্কিড বাগানি ও সংগ্রাহকদের কাছ থেকে। অর্কিড বাগান ভালো করতে হলে পারস্পরিকভাবে সঠিক তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় করা খুব দরকার বলে তিনি মনে করেন। তাঁকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে ব্রাসোভিলা অর্কিড। এ অর্কিড ফুলের সুগন্ধে তিনি বিমোহিত। আর দেশি ফক্সটেইল অর্কিডের ((Rhynchostylis retusa) রূপে তিনি মুগ্ধ। অর্কিড নিয়ে এ দেশে আরও গবেষণা ও চাষ সম্প্রসারণ হওয়া উচিত।