চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়
ছাত্রীদের কাছে প্রধান শিক্ষকের আচরণ ছিল ‘অস্বস্তিকর’
প্রধান শিক্ষক হলেও ছাত্রীদের সঙ্গে তাঁর আচরণ শিক্ষকসুলভ ছিল না, বরং ছিল অস্বস্তিকর। খুদে বার্তা দিয়ে বা ফোন করে ছাত্রীদের ক্রমাগত উত্ত্যক্ত করে যেতেন। এমনকি নারী শিক্ষকেরা পর্যন্ত তাঁর কক্ষে একা যেতে ‘সাহস’ করতেন না।
চট্টগ্রাম নগরের কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে এমন সব অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে তদন্ত কমিটি। অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন গঠিত তদন্ত কমিটি গত সোমবার প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তার কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে।
কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন পরিচালিত। গত ১ জানুয়ারি যৌন নিপীড়নের অভিযোগে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে বিদ্যালয়ের একটি কক্ষে অবরুদ্ধ করে রাখেন অভিভাবক ও ছাত্রীরা। পাশাপাশি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিক্ষোভ করেন তাঁরা। সাড়ে তিন ঘণ্টা পর পুলিশি পাহারায় বিদ্যালয় থেকে বের হন তিনি। পরে তাঁকে সিটি করপোরেশন পরিচালিত দক্ষিণ পতেঙ্গা সিটি করপোরেশন উচ্চবিদ্যালয়ে বদলি করা হয়। পরদিন তাঁকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
এ ঘটনায় সিটি করপোরেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা সৈয়দ শাসসুল তাবরীজকে প্রধান করে তিন সদস্যর কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন সিটি করপোরেশনের শিক্ষা কর্মকর্তা উজালা রানী চাকমা ও আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা তাপ্তি চাকমা।
কমিটি তদন্ত শেষে সোমবার সিটি করপোরেশনের প্রধান শিক্ষা কর্মকর্তা লুৎফুন নাহারের হাতে প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কমিটির আহ্বায়ক সৈয়দ শামসুল তাবরীজ। তবে তিনি বিস্তারিত বলতে রাজি হননি।
সাময়িক বরখাস্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর যা বলার, তা তদন্ত কমিটিকে বলেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, তা সঠিক নয়। একটি গোষ্ঠী পরিকল্পিতভাবে তা করেছে। আর বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হলে আইনগতভাবে পদক্ষেপ নেবেন তিনি।
‘অস্বস্তিকর আচরণ’
কমিটি সূত্রে জানা গেছে, কমিটির সদস্যরা দুই দফা বিদ্যালয়ে সরেজমিনে যান। ওই সময় বিদ্যালয়ের ছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও অফিস সহায়কদের সঙ্গে কথা বলেন কমিটির সদস্যরা। শেষে অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
তদন্ত কমিটির কাছে ছাত্রীরা বলেছে, প্রধান শিক্ষকের আচরণ ছিল অস্বস্তিকর। কোনো বিষয়ে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে দুজন ছাত্রী দেখা করতে গেলে তিনি শুধু একজনকে ঢুকতে দিতেন। একা পেয়ে মুঠোফোন নম্বর নিতেন। পরে মেসেজ দিতেন বা ফোন করতেন। এ ছাড়া ‘বয়ফ্রেন্ড’ আছে কি না, থাকলে ‘গিফট’ দেয় কি না, এ ধরনের অপ্রাসঙ্গিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতেন। এ ছাড়া মোহাম্মদ আলাউদ্দিন ছাত্রীদের ছাড়পত্র (টিসি) দিয়ে বের করে দেওয়া এবং নিবন্ধন বাতিলের হুমকি দিতেন।
অভিযুক্ত প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন তদন্ত কমিটির কাছে প্রথমে তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন। দাবি করেন, তাঁর আইডি হ্যাক হয়েছে। তবে জিজ্ঞাসাবাদের শেষ পর্যায়ে স্বীকার করে নেন, তিনি ছাত্রীদের সঙ্গে ম্যাসেঞ্জারে চ্যাট করতেন।
কমিটির সদস্যদের নারী শিক্ষকেরা জানান, কোনো নারী শিক্ষক প্রধান শিক্ষকের কক্ষে কখনো একা যেতেন না। কাউকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন। কারণ, প্রধান শিক্ষকের চাহনি তাঁদের কাছে অস্বস্তিকর ছিল। প্রধান শিক্ষকের কক্ষে সব সময় ভারী পর্দা টানানো থাকত এবং দরজা বন্ধ থাকত।
নারী শিক্ষকেরা কমিটির কাছে অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন তাঁদের সঙ্গে উগ্র মেজাজ দেখাতেন এবং খারাপ আচরণ করতেন। তাঁর সঙ্গে কোনো বিষয়ে মতানৈক্য হলে তাঁদের পতেঙ্গায় (নগরের এক প্রান্তে) অবস্থিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বদলির হুমকি দিতেন। প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার কথা বলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করতেন। শিক্ষকেরাও ভয়ে প্রতিবাদ করার সাহস করতেন না। তিনি মেয়র ও সংসদ সদস্যের কাছের লোক দাবি করে হুমকি–ধমকি দিতেন।
মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে ছাত্রীদের যৌন নিপীড়নের অভিযোগ নতুন নয়। ২০১৩ ও ২০১৯ সালেও তাঁর বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ ওঠে। তবে ওই সময় বদলি করা হলেও পরে ঠিকই কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে চলে আসেন।
অফিস সহায়কেরা অভিযোগ করেন, প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিন খুব বদরাগী। তিনি তাঁদের কাজের সময় নিয়মিত গালাগালি করতেন।
পেশাদারত্বের পরিচয় দেননি প্রধান শিক্ষক
তদন্ত কমিটি ঘটনাস্থল পরিদর্শন, সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য যাচাই করে প্রতিবেদনে বলেছে, প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আলাউদ্দিনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো প্রাথমিকভাবে সত্য মনে হয়েছে কমিটির কাছে। প্রধান শিক্ষক হিসেবে তিনি পেশাদারত্বের পরিচয় দিতে পারেননি। এ ছাড়া বিদ্যালয়ের ছাত্রী, প্রাক্তন ছাত্রী ও অভিভাবকদের যে আন্দোলন, তা সমসাময়িক কোনো নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়। আগের বিভিন্ন অভিযোগ ও ঘটনাকে কেন্দ্র করে। অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ায় কমিটি তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করে।