নিয়ম না থাকলেও রাজধানীর মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সদস্যসচিব ও সদস্যরা মিলে দেড় কোটি টাকা নিয়েছেন। সম্মানীর নামে ছয় বছরে (২০১৬ থেকে ২০২২ সাল) তাঁরা এই অর্থ নিয়েছেন বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের (ডিআইএ) তদন্তে উঠে এসেছে।
তা ছাড়া যে খাতে ব্যয় নেই, সেই খাতেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যেমন ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে ‘ম্যাগাজিন’ খাতে ৩ কোটি ১ লাখ ৬৭ হাজার আয় করা হলেও এর বিপরীতে এই খাতে কোনো অর্থ ব্যয় করা হয়নি। ডিআইএ বলছে, যে খাতে ব্যয় নেই, সেই খাতে টাকা আদায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের হিসাব নির্দেশিকার পরিপন্থী। এ রকমভাবে বিভিন্ন খাতে কোটি কোটি টাকা নয়ছয় করার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে ডিআইএর প্রতিবেদনে।
পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তরের চারজন কর্মকর্তা এই তদন্ত করেছেন। এর আলোকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে প্রতিবেদনটি ৯ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের কাছে পাঠিয়েছে ডিআইএ। পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিআইএর পরিচালক অধ্যাপক অলিউল্লাহ মো. আজমতগীর প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন। এখন মন্ত্রণালয় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে জবাব (ব্রড শিটে) চাইবে। জবাবের পর তা নিয়ে তিন পক্ষ (মন্ত্রণালয়, ডিআইএ ও প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ) বৈঠক করে পরবর্তী ব্যবস্থা ঠিক করা হবে।
১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় মনিপুর উচ্চবিদ্যালয়। এখন উচ্চমাধ্যমিকও আছে। মূল ক্যাম্পাসসহ কয়েকটি শাখায় এর কার্যক্রম চলে। শিক্ষার্থী প্রায় ৪০ হাজার। শিক্ষক আছেন আট শতাধিক। আর কর্মচারী আছেন পৌনে দুই শর মতো। প্রতিষ্ঠানটি প্রায় চার দশক ধরে এমপিওভুক্ত। তবে সব শিক্ষক-কর্মচারী এমপিওভুক্ত নন। দীর্ঘদিন ধরেই নানা রকমের অভিযোগ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা, তদন্ত, রিট মামলা ইত্যাদি চলছে। অভিযোগ রয়েছে, স্কুল পরিচালনায় সম্পৃক্ত একটি প্রভাবশালী মহল রাজধানীর অন্যতম বড় এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘ইচ্ছেমতো’ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। প্রতিষ্ঠানটি এমপিওভুক্ত হলেও সম্প্রতি একটি ট্রাস্ট গঠন করে তার অধীনে প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় কাজ করার প্রচেষ্টা চলছে।
ডিআইএর প্রতিবেদনের তথ্যের বিষয়ে বক্তব্য জানতে কলেজের ‘অধ্যক্ষ’ ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যসচিব ফরহাদ হোসেনের মুঠোফোন নম্বরে কল করলেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর ব্যক্তিগত সহকারীর মুঠোফোনে কল করলে তিনি জানান, অধ্যক্ষ সকালে একবার প্রতিষ্ঠানে এসেছিলেন। পরে অন্য ক্যাম্পাসে যান।
বর্তমানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে আছেন এ কে এম দেলোয়ার হোসেন। তাঁর মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের একজন কর্মচারী জানান, তিনি বর্তমানে বিদেশে আছেন।
অর্থ নয়ছয়ের যে তথ্য আছে প্রতিবেদনে
ছয় বছরে প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি, সদস্য এবং সদস্যসচিবের (অধ্যক্ষ) সম্মানী বাবদ ১ কোটি ৫৪ লাখ ১৯ হাজার ৬৪৪ টাকা ব্যয় করা হয়েছে। এখানে এই পদগুলোকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার পদ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটির সম্মানী নেওয়ার সপক্ষে কোনো বিধান নেই। এ জন্য এই টাকা প্রতিষ্ঠানের তহবিলে জমা দেওয়ার সুপারিশ করেছে ডিআইএ।
শিক্ষকদের ‘বিশেষ ক্লাস’–এর মাধ্যমে কীভাবে টাকা নেওয়া হয়েছে, সেই তথ্যও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, প্রতিষ্ঠানের বিল, ভাউচার ও ক্যাশ বই যাচাই করে দেখা যায়, মূল ক্লাসের পাশাপাশি ‘বিশেষ ক্লাস’ নেওয়া হয় এবং এ জন্য সম্মানী দেওয়া হয়। কিন্তু ‘বিশেষ ক্লাসের’ সম্মানী বাবদ ব্যয় করা অর্থের বিপরীতে ১০ শতাংশ উৎসে কর কাটা হয়নি। ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ‘বিশেষ ক্লাসের’ সম্মানী বাবদ ২০ কোটি ৯০ লাখ ২৭ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এর বিপরীতে ২ কোটি ৯ লাখের বেশি টাকা রাজস্ব হতে সরকারকে বঞ্চিত করা হয়েছে। উৎসে কর বাবদ এই টাকা সরকারের সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া আবশ্যক বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
তদন্তে দেখা গেছে, ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ঠিকাদার বা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে বিল দেওয়া হলেও ভ্যাট কেটে রাখা হয়নি। এ থেকে সরকার ২২ কোটি ২৭ লাখের বেশি টাকা রাজস্ব হারিয়েছে।
এক সপ্তাহে কোটি টাকার কাজ
মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের ইব্রাহিমপুর ক্যাম্পাসের ভবন রং করা ও মেরামতকাজে বিধিবহির্ভূতভাবে ১ কোটি ১৭ লাখ ৬৭ হাজার টাকার বেশি টাকা ব্যয় করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে বলা হয়, ঠিকাদারকে ৬ সপ্তাহ সময় দিয়ে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। ঠিকাদার ২০২১ সালের ২৬ ডিসেম্বর কার্যাদেশ গ্রহণ করেন। কিন্তু কার্যাদেশপত্র গ্রহণ করার মাত্র ৭ দিন পর প্রকৌশলী বিল পরিশোধের জন্য সুপারিশ করেন। ইব্রাহিমপুর ক্যাম্পাসটি অনেক বড় এলাকা নিয়ে। তাই মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে নির্মাণ, মেরামত ও রং করার কাজ সম্ভব নয়। তাই কাজটি আদৌ করা হয়েছিল কি না, তা সন্দেহজনক। ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ট্রেড লাইসেন্স যাচাই করে ডিআইএ দেখতে পায়, এটি একটি আমদানি-রপ্তানিকারক তৃতীয় শ্রেণির ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির এ ধরনের কাজ করার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। আবার মেরামত ও সংস্কারকাজে কিছু সিমেন্ট ও বালু প্রয়োজন হয়। বালু কেনা দেখানো হলেও এত বড় নির্মাণ, মেরামত ও রং করার কাজে কোনো সিমেন্ট কেনা দেখানো হয়নি। এ কারণে মেরামত ও রং করার এই বিল বা ভাউচার ভুয়া বলে প্রতীয়মান। সার্বিক প্রেক্ষাপটে ওই টাকায় কাজ করা হয়নি। শুধু ঠিকাদারকে আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
ডিআইএর প্রতিবেদনে মোট ১১ দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে অপরিশোধিত আয়কর, ভ্যাট সরকারি কোষাগারে জমা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে জানানো, আর্থিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা, পঞ্জিকা বর্ষের পরিবর্তে অর্থবছর অনুসারে হিসাব সংরক্ষণ ইত্যাদি।
এর আগে ২০২০ সালে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদন্তে অধ্যক্ষ পদে মো. ফরহাদ হোসেনের নিয়োগ অবৈধ প্রমাণিত হয়। এরপর গত বছর ঢাকা মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ডের তদন্তেও বেরিয়ে আসে নির্ধারিত মেয়াদ শেষে অধ্যক্ষের চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি বিধিসম্মত হয়নি। এরপরও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মাউশির মহাপরিচালক অধ্যাপক নেহাল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে সেখানে একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।