গণমাধ্যমের মালিকদের জন্যও নৈতিকতার গাইডলাইন থাকা জরুরি

এমআরডিআই এবং ডেনমার্কভিত্তিক অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা আইএমএস–এর উদ্যোগে আয়োজিত সভা। দ্য ডেইলি স্টার ভবন, কারওয়ান বাজার, ঢাকা। ২৬ আগস্টছবি: প্রথম আলো

দেশে অসংখ্য গণমাধ্যম নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থে গড়ে উঠছে। যে কেউ সাংবাদিকের পরিচয় ব্যবহার করছে কি না, এ বিষয়গুলো দেখতে হবে। সাংবাদিকতার মান নির্ধারণ করে একটি কাঠামোয় আনতে হবে। মিডিয়া ওয়াচের মতো ব্যবস্থা থাকতে হবে। গণমাধ্যমের সংস্কার প্রশ্নে সাংবাদিকদের নীতি-নৈতিকতার পাশাপাশি মালিকদের জন্যও নৈতিকতার গাইডলাইন থাকা জরুরি।

আজ মঙ্গলবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দ্য ডেইলি স্টারে এমআরডিআই এবং ডেনমার্কভিত্তিক অলাভজনক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্টের (আইএমএস) উদ্যোগে এক সভায় এসব কথা বলা হয়। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের চূড়ান্ত সুপারিশমালা বাস্তবায়নে সহায়ক হিসেবে ৫ বছর মেয়াদি একটি কৌশলগত অ্যাডভোকেসি পরিকল্পনা তৈরি করেছে তারা। এই পরিকল্পনা নিয়েই সভাটি অনুষ্ঠিত হয়।

এমআরডিআইয়ের প্রোগ্রাম ম্যানেজার সৈয়দ সামিউল বাশার অনিক এবং স্ট্র্যাটেজিক অ্যাকশন প্ল্যান ডেভেলপমেন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের সদস্য নন্দিতা তাবাসসুম খান এই পরিকল্পনা নিয়ে একটি উপস্থাপনা তুলে ধরেন।

সেখানে তাঁরা সাতটি ফ্রেমওয়ার্কের কথা বলেন–গণমাধ্যমের স্বাধীনতা; নিবন্ধন, মালিকানা এবং পরিচালনায় স্বচ্ছতা; গণমাধ্যমগুলোর নিজস্ব নীতিমালা; সাংবাদিকদের কল্যাণ, অধিকার ও মর্যাদা রক্ষা; গণামধ্যমের আইনি সংস্কার; সমতা, অধিকার ও অন্তর্ভুক্তি এবং সাংবাদিকতার শিক্ষা ও দক্ষতার উন্নয়ন। এ ছাড়া গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের অংশীজনদের সম্পৃক্ততার কথাও বলেন।

গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রধান কামাল আহমেদ অনুষ্ঠানে অনলাইনে যুক্ত হন। তিনি বলেন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো বাস্তবায়নের কথা গত ৫ মাসে সাংবাদিকদের বা সংবাদমাধ্যম–সংক্রান্ত সংগঠনগুলো থেকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কেউ বলছে না। এই জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক বলেন, অসংখ্য সংবাদমাধ্যম গড়ে উঠেছে। নানা ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে এগুলো গড়ে উঠছে। এগুলো কিসের ভিত্তিতে চলবে, আসলেই তারা সাংবাদিকতা করছে কি না, তা জানা যাচ্ছে না। যে কেউ সাংবাদিকের পরিচয় ব্যবহার করছে কি না, গণমাধ্যম চালু করে অপব্যবহার হচ্ছে কি না, এ বিষয়গুলোর সমাধান হওয়া প্রয়োজন।

সাংবাদিক কামাল আহমেদ আরও বলেন, নিউমিডিয়া এখন আলাদা কিছু না। এই বিবেচনায় সাংবাদতিকতার মানকে নির্ধারণ করতে হবে, একটি কাঠামোয় আনতে হবে। তাহলে এখানে শৃঙ্খলা আসবে। মিডিয়া ওয়াচের মতো ব্যবস্থা থাকা দরকার। গণমাধ্যম কী করল, দায়িত্বশীলতা বজায় রাখছে কি না, তার জন্য একটি নাগরিক উদ্যোগ দরকার।

সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের মৃত্যুর ঘটনা প্রসঙ্গে কামাল আহমেদ বলেন, এই করুণ মৃত্যুর ক্ষেত্রে একটি কথা সামনে এসেছে, সরকারের পক্ষ থেকে চাপ এসেছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে ভুল সংশোধনের কথা বলা হয়েছিল নাকি খবর সরিয়ে নেওয়ার জন্য–এ বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।

সাংবাদিক ও প্রশিক্ষক কুর্‌রাতুল-আইন-তাহ্‌মিনা বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাইলে স্ব–নিয়ন্ত্রণে (সেলফ রেগ্যিউলেশন) যেতে হবে। এমআরডিআই এবং আইএমএস–এর কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নে এই খাতসংশ্লিষ্টদের মুখ্য ভূমিকা রয়েছে। যেসব কৌশলগত পরিকল্পনার কথা এসেছে, সেগুলো বাস্তবায়ন কে করবে তা গুরুত্বপূর্ণ। সব সরকার করে দেবে ভাবলে স্বাধীনতাও আসবে না।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, বাংলাদেশে যাঁরা গণমাধ্যমে বিনিয়োগ করতে আসেন, তাঁদের অধিকাংশই পেশাদার গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য নিয়ে আসেন না, আসেন রাজনৈতিক বা নিজেদের সংকীর্ণ ব্যবসায়িক স্বার্থে। এ কারণে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের কোনো দৃঢ় পরিবেশ তৈরি হতে পারেনি। সেটা হলে সাংবাদকিদের স্বাধীনতা, সুরক্ষা, চর্চার ক্ষেত্র অনেক প্রসারিত হতে পারত।

সমকালের সম্পাদক শাহেদ মুহাম্মদ আলী গণমাধ্যম খাতের বিনিয়োগ প্রসঙ্গে বলেন, গণমাধ্যমকে টিকে থাকার জন্য যে পুঁজির কাছে যেতে হয়, সেখানে তাকে পূজা দিয়ে ফিরে আসতে হয়। গণমাধ্যমের পরিণতি এতে ভালো হয় না। যাঁরা গণমাধ্যমে পুঁজির বিনিয়োগ করতে চান, তাঁদের জন্য একটি গাইডলাইন হতে পারে, যেখানে নৈতিকতার বিষয়গুলো মেনে চলতে হবে।

প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশের (পিআইবি) মহাপরিচালক ফারুক ওয়াসিফ বলেছেন, গণমাধ্যম খাতে অবৈধ বিনিয়োগ, বাজে অনুশীলনের মতো বিষয়ে সরকার একা কিছু করতে পারবে না। এ খাতের সংশ্লিষ্টদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

যমুনা টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য ফাহিম আহমেদ বলেন, গণমাধ্যম নিয়ে নানা ধরনের কথা হচ্ছে কিন্তু এখন আর এর স্বাধীনতা নিয়ে কেউ কথা বলছেন না।

সরকারকে আশু করণীয় নিয়ে কিছু সুপারিশ দিয়েছিলেন জানিয়ে দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেসের সম্পাদক ও গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের আরেক সদস্য শামসুল হক জাহিদ বলেন, কিন্তু এরপর কী হয়েছে তা আর জানা যায়নি। সরকারি বিজ্ঞাপন কমেছে এবং বেসরকারি খাতেও বিজ্ঞাপনের অবস্থা অনেকটা কমেছে বলে জানান।

ডেনমার্কভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল মিডিয়া সাপোর্ট (আইএমএস) এর এশিয়া অঞ্চলের প্রধান লার্স হেইবার্গ বাসেল বলেন, গণমাধ্যমের টেকসই পরিবর্তনের পরামর্শ স্থানীয় পর্যায় থেকে আসতে হবে। আইএমএস স্থানীয় অংশীজনদের সঙ্গে মিলে বাংলাদেশে সাংবাদিকদের সুবিধার জন্য একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।

এমআরডিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য দেন সাংবাদিক ও গবেষক আফসান চৌধুরী, চ্যানেল ২৪–এর নির্বাহী পরিচালক তালাত মামুন, গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের সদস্য জিমি আমির, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মশিউর রহমান, ঢাকা ট্রিবিউনের নির্বাহী সম্পাদক রিয়াজ আহমেদ, ইউনেসকোর বাংলাদেশ প্রতিনিধি সুসান ভাইজ, সাংবাদিক ফারহানা রহমান, এশিয়া ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ কাজী ফয়সাল বিন সিরাজ প্রমুখ।