বর্ষারাতের অসহায় অতিথি

প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোতে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনার লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

কিছু কিছু দিন আসে, মনে দাগ কেটে রেখে যায়। অমোচনীয় কালি দিয়ে তা মোছার নয়, কোনোমতেই ভোলারও নয়।

সে রকম একটা বর্ষারাতের কথা। আমাদের সবে বিয়ে হয়েছে। জীবনের সেটা এমন এক সময়, যখন ঘোরার আর পরস্পরকে বোঝার আনন্দটাই প্রবল। আমার চাচাতো বোনের বিয়ে, বোন আমেরিকাপ্রবাসী কনে। বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন ঠিক হয়েছে মহাকালী ট্রাস্ট হলে, রাতের বেলা। স্বাভাবিকভাবেই আমাদেরও সপরিবার নিমন্ত্রণ। আমরা পুরান ঢাকা থেকে যান্ত্রিক দ্বিচক্রযানে করে সর্বত্র যাতায়াত করি। অনুষ্ঠানে যথারীতি আমরাও উপস্থিত হলাম।

পরিবারের বিশাল মিলনমেলা। আমার সদ্য বিবাহিত বউকেও অনেকেই সস্নেহে কাছে টেনে নিচ্ছেন। ওর সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন। এভাবে একসময় খাওয়ার সময় হয়ে এল। খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায়ের পালা। আমরা কনের একেবারে কাছের মানুষ। তাই বের হতে হতে অনেক দেরি হয়ে গেল।

বাইরে বেরিয়ে দেখি প্রবল বৃষ্টি। একটু অপেক্ষা করার কথা ভেবে দাঁড়িয়ে রইলাম। বৃষ্টিটা ধরে আসুক। সঙ্গে ছোট ফুফাতো ভাই। গল্প চলছিল বেশ ভালোই। হলঘর যে কখন ফাঁকা হয়ে গেছে, আমরা খেয়ালই করিনি। আমরা তিনজন ছাড়া কেউ নেই। বাবুর্চিকুলের কোনো লোকও নেই। আমরা হলের বাইরে কোনায় দাঁড়িয়ে। আমার ফুফাতো ভাইও একসময় জুতা–মোজা খুলে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তুমুল বর্ষণের মধ্যেই হেঁটে হেঁটে আবছা হয়ে গেল।

রাত প্রায় একটা। বাইরে তুমুল বর্ষণ। মনে হচ্ছে, আকাশ ফুটো হয়ে গেছে। অবশেষে আমরাও বুঝতে পারলাম, এই দুর্যোগের মধ্যে আমাদেরও বাইক নিয়েই বের হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই।

আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম উত্তর কোণে। এমন সময় সে কোণটিরই পাশে একটা গাছ থেকে কী যেন ঝরে পড়ল। কিচকিচ একটা শব্দও পেলাম। এগিয়ে গিয়ে দেখি, কুচকুচে একটা কালো পাখি জলে পড়ে জবুথবু হয়ে আছে। এগিয়ে গিয়ে হাতে তুলে নিলাম। পাখিটা একটুও পালানোর চেষ্টা করল না। হাতের মধ্যে পাখিটার বেঁচে থাকার ধুকপুকানির অনুভব।

আমার ব্যাগে একটা ভাঁজ করা পলিয়েস্টার ব্যাগ ছিল। সেটা বের করে ওর মধ্যে পাখিটাকে রেখে ব্যাগের ওপর দিকে একটা ফুটো করে মুখটা বেঁধে নিলাম। তুমুল বর্ষণের ভেতর বউকে নিয়ে বাইকে যাত্রা শুরু করলাম। পথ ধরে যাচ্ছি। বৃষ্টিতে প্রায় সবকিছু ঝাপসা হয়ে আছে। বারবার চশমার কাচ মুছে ছুটে চলেছি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির সামনে এসে দেখি, বেশ কিছু ছাত্র বৃষ্টির আনন্দে মেতে উঠেছে। আমাদের দেখে ওরা বোধ করি ভাবল, আমরাও বৃষ্টি উপভোগ করতে বেরিয়ে পড়েছি। কিন্তু আমাদের অবস্থা খুবই নাজুক। একদিকে বউয়ের বেনারসি ভিজে জবজবে। তা ছাড়া আমার ব্যাগের ভেতরে বউয়ের গয়নাগুলো রাখা।

মনের মধ্যে কু–ডাক দিচ্ছে। গুলিস্তান পেরিয়ে নবাবপুরে আসার পর অবস্থা আরও করুণ। রাস্তাভরা পানি, কোথাও খানাখন্দ, কোথাও খোলা ম্যানহোল। ড্রেন উপচে রাস্তায় চলে এসেছে পানি। পানিতে সব সয়লাব। দীর্ঘদিনের চলাচলের অভিজ্ঞতা আর অসমসাহস আমাদের বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে সাহায্য করল।

বাসায় এসে নতুন দায়িত্ব পড়ল পাখিটাকে সারিয়ে তোলার। আলোতে এসে বুঝতে পারলাম, পাখিটা ফিঙেজাতীয় কিছু হবে। কালো কুচকুচে চোখ। মনে হলো, চোখের মণিতে একরাশ পানি। অনেক কষ্টে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে তাকে অনেকটা শুকানো হলো।

ওই রাতে আমরা খুবই সামান্য ঘুমের সুযোগ পেয়েছিলাম। খুব ভোরে অতিথি পাখির কিচকিচ আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। আমরা দুজনেই পাখিটাকে নিয়ে ছাদে চলে গেলাম। মুক্ত আকাশে ভাসিয়ে দিলাম ওকে। ও মুক্ত হয়ে উড়ে উড়ে আমাদের মাথার ওপর দুবার চক্কর খেল। ওর ভাষায় কিচকিচ করে কী যেন বলল। তারপর অসীম আকাশে কোথায় যে ভেসে গেল।

ওই বর্ষারাতের অতিথির অথই কালো চোখ আজও আমাকে স্পর্শ করে। মনে হয়, ওরা সবাই উড়ুক, ঘুরুক, ভালো থাকুক।

  • মানজার চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক, গণসংগীত সমন্বয় পরিষদ