পদচিহ্ন রেখে চলে গেলেন তিনি

আহমদ ইলিয়াস (১৯৩৪–২০২৩)

‘হয়তো আমার পর আমাকে ছাড়িয়ে যাবে কেউ

আমার পেছনে তাই কিছু পদচিহ্ন রেখে গেলাম।’

বাংলাদেশের উর্দু কবি আহমদ ইলিয়াস আর নেই। ঢাকার এভারকেয়ার হাসপাতালে গতকাল বুধবার দুপুরে তাঁর মৃত্যু হয় (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।

বাংলাদেশের ভাষা আর সংস্কৃতির বৈচিত্র্যে তিনি ছিলেন গুরুত্বপূর্ণ একজন। একজীবনে তিন দেশের নাগরিক ছিলেন তিনি। জন্মেছিলেন ব্রিটিশ ভারতে, কলকাতায় ১৯৩৪ সালে। দেশভাগের পর ১৯৫০ সালে ঢাকায় আসেন। প্রগতিশীল লেখক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন সাম্যবাদী রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আর বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে। আর মারা গেছেন স্বাধীন বাংলাদেশে। পেশায় তিনি ছিলেন সাংবাদিক ও উন্নয়নকর্মী। একসময় ঢাকা প্রেস ক্লাবের ম্যানেজার ছিলেন। ছয়টি উর্দু কাব্য সংকলন প্রকাশিত হয়েছে তাঁর। অন্যান্য বইয়ের মধ্যে আছে ‘বিহারিজ: দ্য ইন্ডিয়ান ইমিগ্রিজ ইন বাংলাদেশ’ এবং ‘দ্য ওয়ার্ল্ড আই স’ নামে আত্মজীবনী। সব কটিই প্রকাশিত হয়েছে ঢাকা থেকে। ভারতের কর্ণাটক উর্দু একাডেমি তাঁকে সম্মাননা প্রদান করে। কবি আসাদ চৌধুরীর সঙ্গে মিলে বাংলা-উর্দু সাহিত্য ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি।

নির্বাচিত কবিতা আহমদ ইলিয়াস প্রথমা প্রকাশন

দীর্ঘদিনের বন্ধু কবি নওশাদ নুরির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সূত্র ধরে বাঙালি কবি ও লেখক বন্ধুদের সঙ্গেও পরিচয় ঘটে আহমদ ইলিয়াসের। সব মিলিয়ে বাঙালি ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সঙ্গে তাঁর সংশ্লিষ্টতা তৈরি হয়। নিজে উর্দুভাষী হয়েও এ দেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে কাজ করে সেই সময় তিনি কোণঠাসা হয়ে পড়েছিলেন। ১৯৬৬ সালের আন্দোলনের সময় নওশাদ নুরিরা ছয় দফা উর্দুতে অনুবাদ করে ছেপে বিলি করতেন। সেই প্রয়াসে যুক্ত আহমদ ইলিয়াসও বিশ্বাস করতেন যে সব নিপীড়িত মানুষ এক জাতের। নুরি ১৯৬৯ সালে তাজউদ্দিন আহমদের পৃষ্ঠপোষকতায় উর্দু পত্রিকা ‘জারিদা’ প্রকাশ শুরু করেন। পত্রিকাটি ছিল বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের উর্দু মুখপত্র। আহমদ ইলিয়াস প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে ছিলেন সেই পত্রিকার সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ইলিয়াস লিখেছিলেন ‘কালব্যায়সাখি’ (কালবৈশাখী) নামে কবিতা:

‘আমি জানি, তবু আমি জানি

কালো ঝড়, এই কালো লস্কর

দুইয়েরই নিয়তি পরাজয়

আমি জানি, আমি জানি

প্রদীপ নিভেছে যে ঘরে

সেখানেই উঠবে সূর্য’

দেশভাগ আর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আহমদ ইলিয়াসের কবিতাকে দিয়েছে এক অনন্য অভিজ্ঞতা। তাঁর কবিতায় সেই অভিজ্ঞতা বহু বর্ণে প্রতিফলিত হয়েছে। উপমহাদেশের সাহিত্যে ‘পার্টিশন সাহিত্য’ বা দেশভাগের সাহিত্য নামে একটা পৃথক শাখা রয়েছে। উর্দু সাহিত্যে সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, ইনতিজার হুসেইন সেই শাখার অন্যতম প্রতিনিধি। তবে লক্ষণীয় যে কবিতায় সেই দেশভাগের পরিচয় সরাসরি ফুটে উঠেছে কম। উপমহাদেশের সাহিত্যে আহমদ ইলিয়াস এই জায়গায় এক অতুলনীয় জায়গা দাবি করতে পারেন। দেশভাগের সময় তিনি জন্মভূমি ছেড়ে ঢাকায় এসেছেন। এরপর আবার হয়েছেন দেশহীন, নাগরিকত্বহীন। এমন অনুভব ইলিয়াস ছাড়া উপমহাদেশের আর কারও সাহিত্যে এমনভাবে ফুটে ওঠেনি। কোনো একদিন উপমহাদেশের ‘পার্টিশন লিটারেচর’–এ আহমদ ইলিয়াসের নাম উচ্চারিত হবে বিস্ময়ের সঙ্গে।

বারবার দেশহারা হয়ে তিনি মানুষের ‘দেশ’ নামক ধারণাকে আরও গভীরভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করেছিলেন। ‘দেশ’ নামের সম্পর্ক তো কিছু আইনের গরাদে বন্দী। সেখানে নাগরিকের চাওয়া, ভালোবাসা নিমেষেই তুচ্ছ, অস্তিত্বহীন হয়ে যেতে পারে। ‘কাগজ কা মাকান’ (কাগজের ঘর) নামে এক কবিতায় তিনি লিখেছেন, কেমন করে সাদা কাগজ পেলেই তাঁর আঙুল আপনাআপনি বাড়ির ছবি আঁকতে থাকে। তারপর সেই নিজের আঁকা বাড়ির ছবি দেখে কবি নিজেই ভয় পান। যদি এই কাগজের ঘরও হারিয়ে যায়! যেমন করে হারিয়েছে তাঁর নিজের জমিন, নিজের আকাশ!

আহমদ ইলিয়াস বারবার পুরোনো পরিচয় ফেলে নতুন পরিচয় তৈরি করতে করতে ক্লান্ত হয়েছেন। ধূলিস্যাৎ ঘর আবার তৈরি করেছেন। কিন্তু যে আঙিনায় বসে বন্ধুদের গল্প–কবিতা শুনতেন, সেই আঙিনা আর তৈরি হয়নি। ১৯৪৭-পরবর্তী এই বাংলায় প্রগতিশীল সাহিত্য ও মানবিক সমাজ রূপান্তরের প্রয়াসে আহমদ ইলিয়াস প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু দিন শেষে দেখেছেন যে তাঁর নিজেরই ভাষা ক্রমবিলীয়মান। তিনি চলে গেছেন। দেখে গেছেন যে তাঁর ঘনিষ্ঠ আর দুয়েকজন কবিবন্ধুর পর এই সাহিত্যের আর কোনো অস্তিত্ব থাকবে না বাংলাদেশে। তাঁর গল্প তাঁর ভাষায় লেখার মতো এই দেশে বাকি থাকবে না আর কেউ। তবে সেই আকুতি তাঁর ছিল:

‘কেউ আমারও পথ হারানোর ইতিহাস লিখত যদি

আমি অক্ষরে অক্ষরে ছিন্ন হয়ে ছড়িয়ে আছি পথে।’

মানুষের মুক্তি না হলে সাহিত্যেরও মুক্তি সম্ভব নয়। আহমদ ইলিয়াস তা জানতেন। তাই আমাদের কাছেই যেন সেই আশা রেখে গেছেন তিনি।