ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাভঙ্গের নানা অভিযোগ, তদন্ত কমিটি হলেও নেওয়া হয় না ব্যবস্থা

  • তিনটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি করে হল প্রশাসন। যার মধ্যে দুটির তদন্ত শেষ হয়নি।

  • সর্বশেষ সংঘর্ষের ঘটনায় চার নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীদের মহড়াফাইল ছবি প্রথম আলো

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ উঠলেও খুব কমই ব্যবস্থা নিয়ে থাকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শেষ ছয় মাসে একের পর এক শিক্ষার্থী নির্যাতন, চাঁদাবাজি, সংঘর্ষ, হলের আসন দখল, হুমকি দেওয়ার মতো ঘটনায় ছাত্রলীগের নাম এসেছে। তবে একটি ছাড়া কোনো ঘটনায় প্রশাসনকে ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এতে ছাত্রলীগ আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রের তথ্য ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে অন্তত ২৪টি অভিযোগ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে মারধর, নির্যাতন ও হুমকির অভিযোগ ৮টি, চাঁদাবাজি ২টি, হলে আসন দখল ৬টি, দুই পক্ষের মধ্যে মারামারি ৬টি, ছাত্রদল নেতা-কর্মীদের মারধরের অভিযোগ ২টি।

এর মধ্যে কেবল তিনটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করে হল প্রশাসন; যার দুটির এখনো তদন্ত প্রতিবেদনই জমা পড়েনি। একটি ঘটনায় তদন্ত শেষে ছাত্রলীগের চার কর্মীকে হল থেকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। অপর দিকে একটি ঘটনায় তদন্ত শেষে একজনকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে ছাত্রলীগ। সর্বশেষ ১১ মে সংঘর্ষের ঘটনায় চার নেতাকে সাময়িক বহিষ্কার করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ।

ছাত্রলীগ মনে করছে, তারা আইনকানুনের ঊর্ধ্বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে তারা আশকারা পাচ্ছে।
সালেহ্ হাসান নকীব, অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

তদন্ত কমিটি হলেও শাস্তির নজির কম

অতিথিকক্ষে বসাকে কেন্দ্র করে ১১ মে রাতে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে রাতভর সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। ১৩ মে রাতে এক নেতাকে ‘হত্যার হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে রামদা, রড, লাঠিসোঁটা ও দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দেয় ছাত্রলীগের এক পক্ষ।

এসব ঘটনা তদন্তে ১৪ মে হল প্রশাসন তিন সদস্যের একটি ‘উচ্চতর তদন্ত কমিটি’ গঠন করে। দুই কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও কমিটি জমা দিতে পারেনি। তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক অনুপম হীরা মণ্ডল বলেন, তাঁরা আবেদন করে প্রতিবেদন জমার সময় বাড়িয়ে নিয়েছেন।

এর আগে ৭ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলে এক শিক্ষার্থীকে মারধরের হুমকি দেওয়ার অভিযোগ ওঠে শাখা ছাত্রলীগের পাঁচ নেত্রীর বিরুদ্ধে। এ ঘটনায় হল প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলেও এখন পর্যন্ত জমা হয়নি।

অবশ্য গত ২৫ নভেম্বর শহীদ হবিবুর রহমান হলে এক সাংবাদিক ও এক শিক্ষার্থীকে মারধরের ঘটনায় চারজনকে হল থেকে বহিষ্কার করে প্রশাসন। আরেক কর্মীকে মুচলেকা নিয়ে চূড়ান্ত সতর্ক করা হয়। 

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই ক্যাম্পাসে দেশি অস্ত্র নিয়ে মহড়া দিতে দেখা যায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের। গত ১৩ নভেম্বর রাতে নবাব আবদুল লতিফ হলে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ দেশি অস্ত্র নিয়ে মুখোমুখি অবস্থান নেয়। ৫ মার্চ মাদার বখ্শ হলের ফটকে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এ সময় এক পক্ষের নেতা-কর্মীদের হাতে রড ও লাঠিসোঁটা দেখা গেছে। সর্বশেষ ১৩ মে রাতেও ক্যাম্পাসে দেশি অস্ত্রের মহড়া দেখা যায়। প্রায়ই প্রকাশ্যে এমন অস্ত্রের মহড়ার বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।

সার্বিক বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহ-উপাচার্য সুলতান-উল-ইসলাম বলেন, ‘কোনো ছাত্রসংগঠন যেন অছাত্রসুলভ আচরণ না করে, আমরা সে বিষয়ে সব সময় নির্দেশনা দিই এবং সতর্ক অবস্থানে আছি। কেউ যদি অপরাধের সীমা অতিক্রম করে, তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর আগে কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রশাসন ব্যবস্থাও নিয়েছে।’

মীমাংসায় ‘আগ্রহী’ ছাত্রলীগ

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মারধর ও আসন দখলের মতো ঘটনার বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মীমাংসার পথে হেঁটেছে ছাত্রলীগ। ১৫ মে মাদার বখ্শ হলে মধ্যরাতে এক শিক্ষার্থীকে ঘুম থেকে তুলে আসন থেকে বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। পরে হল প্রশাসন ও ছাত্রলীগের জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যস্থতায় ওই ছাত্রকে আবার হলের আসনে তুলে দেওয়া হয়।

এর আগে গত বছরের ২২ নভেম্বর শহীদ শামসুজ্জোহা হলে আসন দখল করতে না চাওয়ায় শাহাবুদ্দিন নামের ছাত্রলীগের এক কর্মীকে মারধরের অভিযোগ ওঠে ওই হল ছাত্রলীগের সহসভাপতি রনি হোসেনের বিরুদ্ধে। এই ঘটনাও পরে মীমাংসা করে দেন জ্যেষ্ঠ নেতারা। শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা ফজলে রাব্বি ও কয়েকজন নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে গত ১ ডিসেম্বর আবির হোসাইন নামের এক শিক্ষার্থীর বিছানাপত্র নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। খবর পেয়ে হল প্রশাসন ও ছাত্রলীগ নেতারা ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীকে আবারও আসনে তুলে দেন। তবে আসন-বাণিজ্যের চেষ্টার অভিযোগে গত ৩০ জানুয়ারি শহীদ শামসুজ্জোহা হল ছাত্রলীগের কর্মী আল আমিন পিয়াসকে সংগঠন থেকে সাময়িক বহিষ্কার করা হয়।

এদিকে গত ৬ মার্চ ক্যাম্পাসের ভ্রাম্যমাণ দোকান থেকে চাঁদা আদায়ের অভিযোগ ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন নেতার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া গত ১২ মার্চ একটি ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান থেকে ১০ হাজার টাকা চাঁদা দাবির অভিযোগ ওঠে দুই নেতার বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি ছাত্রলীগ কিংবা প্রশাসন।

আরও পড়ুন

গত বছরের অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের নতুন কমিটি দায়িত্ব নেয়। সংগঠনের সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন যে সমস্যা হয়েছে, আমরা তাৎক্ষণিক সে বিষয়গুলো খোঁজখবর নিয়েছি। কিছু কিছু বিষয়ে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি বা সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায়নি। তবে কিছু কিছু বিষয়ে ছাত্রদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়েছিল, সেগুলো আমরা কথা বলে সঙ্গে সঙ্গেই সমাধান করেছি।’

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথেষ্ট আন্তরিকতার অভাব এবং অবহেলা আছে বলে মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সালেহ্ হাসান নকীব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের উৎপাত
বেড়ে যাওয়ার পেছনে অনেকগুলো কারণ আছে। ছাত্রলীগ মনে করছে, তারা আইনকানুনের ঊর্ধ্বে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা নিতে পারছে না। এ ক্ষেত্রে তারা আশকারা পাচ্ছে। তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছে।’ (শেষ)

আরও পড়ুন