‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস খুব কষ্টের, তাই পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য হলাম’

ওয়ালিদ ইসলামছবি: ফেসবুক থেকে নেওয়া

লিঙ্গ বৈচিত্র্য নিয়ে জন্ম নিয়েছেন ওয়ালিদ ইসলাম। এখন তাঁর পরিচয় তিনি বাংলাদেশ দূতাবাস তেহরানের ফার্স্ট সেক্রেটারি। জন্মের ৩৪ বছর পর ১০ জানুয়ারি ফেসবুকে ওয়ালিদ নিজের হিজড়া পরিচয় প্রকাশ করেছেন। তারপর থেকেই তাঁকে নিয়ে চলছে আলোচনা।

ফেসবুকের পোস্ট দেখে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করলে হোয়াটসঅ্যাপে কথা হয় ওয়ালিদের সঙ্গে। বললেন, ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস খুব কষ্টের, তাই পরিচয় প্রকাশ করতে বাধ্য হলাম। আমার বা আমার মতো যাঁরা, তাঁরা ছাড়া এই আইডেন্টিটি ক্রাইসিসের যে কষ্ট তা কেউ বুঝতে পারবে না। যেখানেই যাই, সেখানেই শুনতে হয়—আপনি এভাবে কেন কথা বলেন, এভাবে কেন হাঁটেন। অনেকে বাজে ইঙ্গিত করেন। কেউ কেউ জড়িয়ে ধরেন। এসব খুব বিরক্ত লাগে।’

ওয়ালিদ তাঁর ফেসবুকের পোস্টে নিজেকে বাংলাদেশ এবং বিশ্বের প্রথম হিজড়া কূটনীতিক হিসেবে দাবি করেছেন। একই সঙ্গে এই জীবনে পদে পদে যে হেনস্তার শিকার হয়েছেন তা–ও তুলে ধরেছেন।

ওয়ালিদরা আট ভাইবোন, এখন অবশ্য এক বোন মারা গেছেন। বাবা ছিলেন ট্রাকচালক। তাঁরা থাকতেন বস্তি এলাকায়। ওয়ালিদের যখন ১০-১১ বছর বয়স, তখন বাবাকে হারান। তারপর থেকে তাঁকে মা, বড় ভাই আর সেজ ভাই আগলে রেখেছেন। আর্থিক সমস্যার মধ্যেও তাঁরা ওয়ালিদকে ভালো স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন।

ওয়ালিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে পড়াশোনা করেন। প্রথমবার বিসিএসে নন-ক্যাডারে চাকরি পেয়েছিলেন। পরে ৩৫তম বিসিএস দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে ঢোকেন। ওয়ালিদ তেহরানে দায়িত্ব পালন করছেন গত আড়াই বছর ধরে।

ওয়ালিদ বললেন, তাঁর পরিবার সব সময় চেয়েছে, শুধু লিঙ্গগত ত্রুটির জন্য বা হিজড়া পরিচয়ের জন্য যাতে কোনো বাজে পরিস্থিতির শিকার হতে না হয়। তাই ভালো স্কুলে পড়িয়েছেন। স্কুল বাসে করে স্কুলে যেতেন আবার স্কুল বাসে করে বাড়ি ফিরতেন। বিভিন্ন সময়ই ওয়ালিদকে এলাকার হিজড়ারা তাদের ডেরায় ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। সেসব আক্রমণ ঠেকিয়েছেন পরিবারের সদস্য এবং এলাকার লোকজন। ফলে ওয়ালিদকে হিজড়াদের ডেরায় বড় হতে হয়নি। আট বছর ধরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা তিনি।

নিজের আঁকা ছবি বাঁধিয়ে রেখেছেন বসার ঘরে
ফেসবুক থেকে নেওয়া

এর আগে প্রকাশ্যে নিজের পরিচয় প্রকাশ না করলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রশিক্ষক, সহপাঠী, সহকর্মীসহ বিভিন্নজন ওয়ালিদকে নানাভাবে বুলি বা হেনস্তা করতে ছাড়েননি। তবে এটাও ঠিক, কর্মক্ষেত্রসহ বেশির ভাগ মানুষই অপ্রকাশ্যভাবে তাঁর পরিচয় জানার পরও তাঁকে সম্মান করেছেন বা এখনো করেন।

গোপালগঞ্জে বাড়ি হলেও ওয়ালিদ বড় হয়েছেন যশোরে। আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো প্রশিক্ষণের সুযোগ না পেলেও ওয়ালিদ ছবি আঁকেন। গান লেখেন, গান গাইতে পারেন। নিজের হাতে বানান নানান জিনিস। তেহরানের বাসাকে নিজের আঁকা এবং বানানো বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজিয়েছেন। এর বাইরে বাংলাদেশের শিকা, কাঁথা সেলাইয়ের হস্তশিল্প, তেহরানসহ বিভিন্ন জায়গার ঐতিহ্যবাহী শোপিসও আছে তাঁর বাসায়। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকেরা তাঁর বাসাকে জাদুঘর হিসেবেই আখ্যা দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

ওয়ালিদ প্রথম আলোকে বলেন, বস্তি এলাকায় থাকতেন তাঁরা। কিন্তু ভালো ছাত্র হিসেবে এলাকায় সুনাম ছিল। ইংরেজি ভাষাটাও ভালো রপ্ত করেছিলেন। স্কুল থেকেই বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার নজর কেড়েছিলেন। সব মিলে এলাকার মানুষও তাঁকে ভালোবাসতেন। কর্মক্ষেত্রেও মেধার জন্য কেউ তাঁকে আটকাতে পারেননি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মেসি বিভাগে পড়াশোনা করেন।

একজন ওয়ালিদ ইসলাম শুধু বাংলাদেশ না, গোটা বিশ্বের গর্ব। যাঁরা তৃতীয় লিঙ্গের হয়ে জন্ম নেন, ওয়ালিদ ভাইকে দেখে তাঁরাও স্বপ্ন দেখার সাহস পাবেন সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার।
মাসরুফ হোসেন, বিশেষ পুলিশ সুপার (এসবি), বাংলাদেশ পুলিশ

ওয়ালিদ প্রথমবার বিসিএসে নন-ক্যাডারে চাকরি পেয়েছিলেন। পরে ৩৫তম বিসিএস দিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে ঢোকেন। ওয়ালিদ তেহরানে দায়িত্ব পালন করছেন আড়াই বছর ধরে।

শিক্ষাগত সনদসহ সব জায়গায় ওয়ালিদ নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। তিনি জানান, তিনি যখন বিসিএস দিয়েছেন, তখন নারী-পুরুষের পাশাপাশি ‘অন্যান্য’ এভাবে লিঙ্গ পরিচয় দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এ ছাড়া তিনি নিজেও এত দিন অন্য কোনো পরিচয়কে সামনে আনেননি। হিজড়া সংস্কৃতিতে বড় হননি বলে নিজেকে হিজড়াও বলেননি। ফেসবুকের পোস্টে প্রথম নিজেকে ‘তৃতীয় লিঙ্গের (হিজড়া) ’ একজন হিসেবে প্রকাশ করেন। সরকার অবশ্য গেজেট প্রকাশ করে ওয়ালিদের মতো যাঁরা আছেন তাঁদের নারী, পুরুষের পাশাপাশি হিজড়া লিঙ্গ (তৃতীয় লিঙ্গ নয়) হিসেবে স্বীকৃতি দেয় ২০১৪ সালে।

শিক্ষাগত সনদসহ সব জায়গায় কূটনীতিক ওয়ালিদ নিজেকে একজন পুরুষ হিসেবেই পরিচয় দিয়েছেন। হিজড়া সংস্কৃতিতে বড় হননি বলে নিজেকে হিজড়াও বলেননি। সম্প্রতি ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে নিজেকে একজন হিজড়া হিসেবে প্রকাশ করেন।

মায়ের সঙ্গে ওয়ালিদ
ছবি: সংগৃহীত

ওয়ালিদ একজনকে ভালোবাসতেন, তা পারিবারিকভাবে বিয়ের সিদ্ধান্ত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। তাই অস্ত্রোপচার করে ওয়ালিদ নারী হতে চেয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত প্রেমের সম্পর্ক বিয়ে পর্যন্ত গড়ায়নি।

তাই কিছু অস্ত্রোপচার বাকি থাকলেও তিনি আর সেগুলোতে যাননি। বিভিন্ন শিক্ষাগত সনদও পরিবর্তন করেননি।

পরিচয় প্রকাশের পর ওয়ালিদকে নিয়ে ফেসবুকে আলোচনা চলছেই। তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন বেশির ভাগ মানুষ। তারপরও কেউ কেউ মন্তব্যে ব্যঙ্গ বা বুলি করছেন। কোনো সুবিধা আদায় বা মানুষের কাছ থেকে সমবেদনা পাওয়ার জন্যই তিনি পরিচয় প্রকাশ করেছেন বলেও বলছেন অনেকে। তবে ওয়ালিদ এসব আর গায়ে মাখছেন না। তিনি বলেন, ‘পরিচয় প্রকাশের পর হালকা বোধ করছি। আমার কারও কাছ থেকে কোনো সিমপ্যাথি পাওয়ার কিছু নেই। মা, ভাই ও পরিবারের অন্য সদস্যরা শুধু ভয় পাচ্ছেন, পরিচয় প্রকাশ করার ফলে নতুন করে কোনো ঝামেলায় পড়ি কি না।’

ওয়ালিদ বারবার তাঁর পরিবারের সদস্যদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘বেশির ভাগ পরিবার এমন সন্তানের জন্ম হলে তাকে পরিবার থেকে বের করে দেয়। আমার বেলায় উল্টো হয়েছে। অন্যদের চেয়ে আমাকে সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বড় করেছে। তাই আমি আজ কূটনীতিক হিসেবে পরিচয় দিতে পারছি।’

তেহরানের আগে চীন, জাপান, মালয়েশিয়া ও ভারতে দায়িত্ব পালন করেছেন ওয়ালিদ। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশে কাজ করার ফলে অনেক বিড়ম্বনা থেকে তিনি অনেকটাই রেহাই পেয়েছেন, যা বাংলাদেশে থাকতে হলে হয়তো পেতেন না।

ওয়ালিদ গান লেখেন, গান গাইতে পারেন। নিজের হাতে বানান নানা জিনিস। তেহরানের বাসা নিজের আঁকা এবং বানানো বিভিন্ন জিনিস দিয়ে সাজিয়েছেন।

মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ওয়ালিদ বলেন, ‘আমার মা আমিনা বেগম পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মা। তাঁর ঘরে আমার জন্ম না হলে আমিও হয়তো হিজড়া ডেরায় বড় হতাম। তালি বাজিয়ে বা অন্যভাবে টাকা উপার্জন করতাম। মা, বড় ভাই আর সেজ ভাই আমার জন্য যা করেছেন, সেই ঋণ আমি কোনো দিনও শোধ করতে পারব না।’ পরিবারের পাশাপাশি নিজের বর্তমান কর্মক্ষেত্র এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন ওয়ালিদ।

১০ জানুয়ারি ওয়ালিদ ফেসবুকে পোস্ট দেওয়ার পর বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণির মানুষ তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহস করে নিজের পরিচয় প্রকাশ করার জন্য শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। বাংলাদেশ পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) বিশেষ পুলিশ সুপার মাসরুফ হোসেন ওয়ালিদকে নিয়ে এক পোস্টে লিখেছেন—‘একজন ওয়ালিদ ইসলাম শুধু বাংলাদেশ না, গোটা বিশ্বের গর্ব। যারা তৃতীয় লিঙ্গের হয়ে জন্ম নেয়, ওয়ালিদ ভাইকে দেখে তারাও স্বপ্ন দেখার সাহস পাবে সমাজের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যাওয়ার। আমি নিজেও ওনাকে দেখে অনুপ্রেরণা পেয়েছি, বাধা ডিঙিয়ে স্বপ্ন পূরণের সাহস পেয়েছি।’ তিনি তাঁর পোস্টে ওয়ালিদের প্রতি যে অত্যাচার বা অবিচার করা হয়েছে, সেগুলো যাতে বন্ধ হয় সে আহ্বানও জানিয়েছেন। এখনো কোনো অন্যায় হলে ওয়ালিদের পাশে দাঁড়ানোর কথা লিখেছেন।

নিজের বাসায় এ যেন এক টুকরো বাংলাদেশ
ছবি: সংগৃহীত

ফেসবুকে পরিচয় প্রকাশ করে পোস্ট দেওয়ার পর ওয়ালিদ আরও কয়েকটি পোস্ট দিয়েছেন। এমনই একটি পোস্টে ওয়ালিদ লিখেছেন, ‘৩৪ বছর ধরে যে মানুষটা আইডেন্টিটি লুকিয়ে বা আইডেনটিটি ক্রাইসিসে ভুগেছেন, তাঁর কি উচিত নয় লুকোচুরি না খেলে সবকিছু খুলে বলা?’

ওয়ালিদ ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি বাংলাদেশের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের ক্যাডার অফিসার এবং বিশ্বের প্রথম তৃতীয় লিঙ্গের কূটনীতিক। নিজের সঙ্গে নিজে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ক্লান্ত আমি। তাই ঢাকঢাক গুড়গুড় ভাব নিয়ে আর কত দিন? হয়তো আমাকে এখানে মানায় না, আমার অবস্থান হওয়ার কথা ছিল হিজড়া ডেড়ায়। ...হয়তো এই ভদ্র মানুষের সমাজ আমার জন্য নয়।’