দেশে মোট শ্রমশক্তির মধ্যে ৫৭ শতাংশের বেশি নারী কোনো শ্রমে নেই। এ হার শহরে বেশি। শহরে বসবাসকারী নারীদের ৭৬ শতাংশ শ্রমশক্তির বাইরে। তাই নারীর চাহিদার ওপর ভিত্তি করে লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিতে (জেন্ডার লেন্সে) বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ছাড়া নারীর প্রতি বৈষম্য দূর হয় না। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে, তা সুনির্দিষ্ট করার এ আহ্বান জানানো হয় এক আলোচনা সভায়।
আজ রোববার বিকেলে রাজধানীর সেগুনবাগিচায় মহিলা পরিষদের কার্যালয়ের সুফিয়া কামাল ভবনের ‘আনোয়ারা বেগম মুনিরা খান মিলনায়তনে’ এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘নারী-পুরুষের সমতা নিশ্চিত করতে নারীর জন্য বিনিয়োগ অপরিহার্য’ শিরোনামে প্রাক্–বাজেট এই আলোচনা সভায় বক্তারা বলেন, নারী–পুরুষের সমতার ভিত্তিতে জেন্ডার লেন্সে বিনিয়োগ না হলে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হবে না।
সভায় ‘জেন্ডার বাজেট স্টেকহোল্ডার কনসালটেশন–২০২৪’ (লিঙ্গভিত্তিক বাজেট অংশীদারবিষয়ক পরামর্শ) শিরোনামে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মী। গত বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারো (বিবিএস) প্রকাশিত সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি বলেন, শহরে ৭৬ শতাংশ এবং গ্রামে ৪৯ শতাংশ নারী শ্রমশক্তির বাইরে রয়েছেন। শহরে এ হার এত বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে ধারণা করা যায়, পোশাক খাতে নিয়োগ সংকুচিত হওয়া। এ খাতে নারী কর্মীদের ব্যাপক অংশগ্রহণ থাকায় শহরের শ্রমশক্তিতে নারীর হার বেশি ছিল। ২০১৬–১৭ প্রতিবেদনেও শহরের শ্রমশক্তিতে নারীর হার ছিল ৬৯ শতাংশ। অপরদিকে গ্রামে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৪ শতাংশে। তবে কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি হলেও খুব কম নারীর জমির মালিকানা রয়েছে। ফলে নারীদের কৃষক হিসেবে স্বীকৃতি নেই। সম্পত্তিতে নারীর সম–অধিকার না থাকায় নারী নিজস্ব ভূমি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বাজেট বরাদ্দে নারীর জন্য আলাদা ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব না দিলে নারীর প্রতি সহিংসতাও বন্ধ করা যাবে না। আইসিডিডিআরবির গবেষণায় বলা হয়েছে, শহরের ৫০ শতাংশ পুরুষ মনে করেন, নারীদের নির্যাতন সহ্য করতে হবে। বিনিয়োগ কতটা জরুরি, সেটা প্রমাণ করে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের সাক্ষরতার হারের সমতা অর্জনের বিষয়টি। উপবৃত্তির কারণে নব্বই দশকে জন্ম নেওয়া মেয়েরা সাক্ষরতার হারে সমতা অর্জন (৯৬ শতাংশ) করতে পেরেছে।
আলোচনা সভায় সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে সংসদ সদস্য আরমা দত্ত বলেন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাজেট নিশ্চিত করতে বাজেট তৈরির আগে নারী অধিকারকর্মীদের পরামর্শও নেওয়া প্রয়োজন। এতে করে নারীর জন্য কোথায় গুরুত্ব দিতে হবে, সে সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষণা পরিচালক মনজুর হোসেন বলেন, নারীকে বাদ দিয়ে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব নয়। ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী নারীদের মধ্যে সাক্ষরতায় সাম্য অর্জিত হওয়ায় তাদের আরও কীভাবে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত। আর ৩০ বছরের বেশি বয়সী নারী যাঁরা হয়তো শ্রমশক্তিতে সেভাবে নেই, বাড়িতে কাজ করেন, তাঁদের নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। সম্পত্তির অধিকার আদায় করে নিতে হবে। আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বাড়াতে বিভিন্ন গোষ্ঠীর নারীদের লক্ষ্য করে সুনির্দিষ্ট কর্মসূচি নিয়ে কাজ করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাজেট উপস্থাপনের আগে বাজেটের নীতিগত কাঠামোতে নারীর জন্য কী কী থাকা দরকার, তা নিয়ে সংসদে আলোচনা হতে পারে। ২০২৬ সালে দেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বের হয়ে যাবে (এলডিজি গ্র্যাজুয়েশন)। ফলে এখন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান (এনজিও) যে হারে বিদেশি তহবিল পায়, ততটা পাবে না। এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়বে নারীর ওপর। কারণ, এনজিওগুলো নারীদের নিয়েই বেশি কাজ করে। ওই সময়ের কথা চিন্তা করে সরকারের উচিত এলডিজি গ্র্যাজুয়েশন তহবিল গড়ে তোলা। তিনি আরও বলেন, কৃষিতে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার বড় কারণ হচ্ছে পুরুষেরা ভিন্ন কোনো পেশায় শহরে চলে যাচ্ছেন। বাধ্য হয়ে পুরুষের ছেড়ে দেওয়া জায়গা পূরণ করছেন নারী। তবে সেখানেও মজুরিবৈষম্য প্রকট।
দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (টিবিএস) পত্রিকার উপসম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান বলেন, মেয়েদের শিক্ষায় অগ্রগতি হলেও উচ্চশিক্ষায় কেন নারী কমে যাচ্ছে, তা নিয়ে গবেষণা হওয়া দরকার। এতে করে একজন নারীর ব্যক্তিগত ক্ষতি যতটা, তার চেয়েও দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি।
সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ উইমেন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক প্রীতি চক্রবর্তী।
সভায় মহিলা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক সীমা মোসলেম বলেন, নারী আন্দোলনের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের ৪৪টি মন্ত্রণালয়ে লিঙ্গভিত্তিক বাজেট প্রণয়ন হচ্ছে। তবে সেটা সমতা প্রতিষ্ঠায় কতটা কার্যকর, তা নজরদারি করতে হবে।
সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে সামাজিক ক্ষমতায়ন হয়। তাই নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এই তিন বিষয় একটির সঙ্গে অপরটি সম্পৃক্ত। তাই বাজেট বরাদ্দ করার সময় এই তিন ক্ষেত্রে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। জেন্ডার সাড়াদানকারী বাজেট নারীর জীবনে কতটা পরিবর্তন এনেছে, তার ওপর কোনো গবেষণা ও পর্যবেক্ষণ নেই। নারীর জন্য কোথায় কোথায় বিনিয়োগ করা উচিত, কোথায় বিনিয়োগে জোর দেওয়া উচিত, তা বোঝার জন্য এই পর্যবেক্ষণ জরুরি।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংগঠনের আন্দোলন সম্পাদক রাবেয়া খাতুন।