এক পাশে উচ্ছেদ, আরেক পাশে পাহাড় কেটে বসতি

ঝুঁকিপূর্ণ ঘর নির্মাণ করেছেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে টাকা নেন তাঁরা।

পাহাড়ের পাদদেশে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ বসতি উচ্ছেদ। সোমবার চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর স্টেশনের আইডব্লিউ কলোনিতে
জুয়েল শীল

পাহাড় কাটা হয়েছে খাড়াভাবে। এরপর সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে বসতি। সারি সারি টিনের ঘর। ঘরগুলো নির্মাণ করেছেন রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে ভাড়া দিয়ে নিয়মিত টাকা নেন তাঁরা। আর জীবনের ঝুঁকি জেনেও সেখানে বসবাস করছেন নিম্ন আয়ের মানুষ।

চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহর রেলওয়ে স্টেশনের ঠিক পেছনে রেলওয়ের মালিকানাধীন পাহাড় কেটে এসব ঘর নির্মাণ করেছেন স্থানীয় যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা। অথচ এর সামনেই রয়েছে রেলওয়ের ভূসম্পত্তি বিভাগের কানুনগো কার্যালয়। কার্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চোখের সামনেই পাহাড় কেটে বসতি গড়ে তোলা হয়েছে। আট থেকে দশ বছর আগে এসব ঘর নির্মাণ করা হয়েছিল।

রেলওয়ের এই পাহাড়ের আরেক অংশে (উত্তর-পূর্ব দিকে) পাহাড় ধসে মৃত্যু হয়েছে সাত মাস বয়সী কন্যাশিশু ও তাঁর বাবার। বাবা-মেয়ের মৃত্যুর পর ঘুম ভাঙে প্রশাসনের। অবৈধ ও ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনাগুলো উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। তবে কানুনগো কার্যালয়ের পেছনের পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসত রয়ে গেছে।

আরও পড়ুন

এ ব্যাপারে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূসম্পত্তি কর্মকর্তা সুজন চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ষোলশহর স্টেশন এলাকায় পাহাড় কেটে নির্মাণ করা ঘরগুলো অবৈধ। এগুলো রেলের জায়গা। ঝুঁকিপূর্ণ এসব ঘর উচ্ছেদে দ্রুত অভিযান চালানো হবে।

জায়গা রেলের, ভাড়া নেন ক্ষমতাসীনেরা

রেলওয়ের কানুনগো কার্যালয়ের পেছনে প্রায় ৪০ শতক জায়গা দখল করে নিয়েছেন একাধিক ব্যক্তি। নিজেরা সেখানে করেছেন কলোনি। এর মধ্যে রয়েছে কবির কলোনি, বক্কর কলোনি, ইউসুফ কলোনি, জসিম কলোনি। এসব কলোনিতে প্রায় এক শ পরিবার থাকে।

মূলত দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা স্বল্প আয়ের মানুষের এসব ঘর ভাড়া দেওয়া হয়েছে। এক কক্ষের ঘরের জন্য ভাড়া দুই থেকে চার হাজার টাকা। কবির হোসেন, আবু বক্কর, মো. সালাম, মো. ইউসুফসহ অন্তত আটজন এসব কলোনি তৈরি করে ঘর ভাড়া দিয়েছেন বলে জানান ভাড়াটেরা। প্রতিটি কলোনিতে ১০, ১৫ বা ১৬টি করে ঘর রয়েছে। ঘরগুলোতে বিদ্যুৎ–সংযোগ থাকলেও পানি ও গ্যাস নেই। নিজেরা গভীর নলকূপ স্থাপন করে পানির ব্যবস্থা করেছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কবির হোসেন ওয়ার্ড পর্যায়ে স্বেচ্ছাসেবক লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তাঁর কলোনিতে ১৬টি ঘর রয়েছে। আবু বক্কর আগে যুবলীগের ওয়ার্ড কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। তাঁর ভগ্নিপতি সালামেরও কলোনি রয়েছে।

অবশ্য আবু বক্কর দাবি করেছেন, ওখানে তাঁর কোনো কলোনি নেই। তাঁর ভগ্নিপতির কলোনি রয়েছে।

আরও পড়ুন
পাহাড়ের পাদদেশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস। বুধবার চট্টগ্রাম নগরের ষোলশহরে রেলওয়ে এস্টেট বিভাগের পেছনে
ছবি: প্রথম আলো

রেলওয়ের কানুনগো কার্যালয়ের সার্ভেয়ার মো. সলিম উল্লাহ চৌধুরী বলেন, অবৈধভাবে এসব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এগুলো উচ্ছেদে ব্যবস্থা নিতে তাঁরা ভূসম্পত্তি বিভাগে লিখেছেন।

রেলওয়ের কাটা খাড়া পাহাড়ের ঠিক নিচেই রয়েছে কবিরের কলোনি। ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে কলোনির একটি টিনের ঘরে থাকেন রাশেদা বেগম। তাঁকে দিতে হয় আড়াই হাজার টাকা। বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করে সংসার চালান তিনি।

পাহাড়ের নিচে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের বিষয়ে সচেতন নাগরিক কমিটির (সনাক) চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি দেলোয়ার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, চট্টগ্রামের পাহাড় রক্ষায় যে উদ্যোগ থাকার কথা, তা নেওয়া হয়নি। উল্টো পাহাড় কাটার পরিমাণ বেড়েছে। আবার মাঝেমধ্যে পাহাড় রক্ষার নামে স্বল্প আয়ের মানুষদের অমানবিকভাবে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু যাঁরা পাহাড় কাটেন, তাঁদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।