কথাগুলো যে কেবল তাঁর সহধর্মিণী বা পরিবারের বন্ধুদের বলতেন, তা নয়; জানাতেন বিলাতে তাঁর সতীর্থ বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিংকেও। কারণ, হকিং চাইতেন, জামাল নজরুল ইসলাম বিলাতেই থেকে যান। হকিং প্রায়ই বলতেন, ‘তুমি এখানে থেকেই তো দেশের জন্য অনেক কাজ করতে পারো।’

বিলাতে থেকেও দেশের জন্য যে কাজ করা যায়, জামাল নজরুল ইসলাম সেটি জানতেন। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ব্রিটিশ সরকার যেন বাংলাদেশের পক্ষে থাকে, সে জন্য প্রায় সব ব্রিটিশ এমপির কাছে চিঠি লিখেছেন। এমনকি ব্রিটিশ এমপি লর্ড বাটলারের মাধ্যমে গণচীনের সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী চু এন লাইয়ের কাছে অনুরোধ করেন যেন চীন পাকিস্তানের পক্ষে না দাঁড়ায়।

তবে হকিংয়ের কথামতো এ রকম কিছু করাটা বাংলাদেশের মতো নতুন একটি দেশের জন্য যথেষ্ট ছিল না। বিশ্বে মাথা তুলে দাঁড়াতে হলে বাংলাদেশের তরুণদেরও বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোতে অবাধ সন্তরণ শিখতে হবে। কেমব্রিজে নিজের গবেষণা করে বাংলাদেশের তরুণ-তরুণীদের একটি নতুন, চ্যালেঞ্জিং জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়। এ কারণে জামাল নজরুল ইসলাম দেশে ফেরেন। স্মর্তব্য, মধ্য আশির দশকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর মূল বেতন নির্ধারণ করা হয় মাত্র তিন হাজার টাকা! সেই সময় অনেকেই তাঁর এ সিদ্ধান্তে অবাক হয়েছেন, কিন্তু জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি জানতেন, তিনি ভুল করেননি।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাল নজরুল ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেন গাণিতিক ও ভৌতবিজ্ঞান গবেষণাকেন্দ্র। নিজের কাজ দিয়ে জানতেন, তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান আর কসমোলজির আঙিনায় চড়ে বেড়ানোর মতো শিক্ষার্থী এ দেশেই আছে। দরকার কেবল তাঁদের পথ দেখিয়ে দেওয়া এবং রসদ জোগানো। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই রিসার্চ সেন্টার ফর ম্যাথেমেটিক্যাল ও ফিজিক্যাল সায়েন্সে তাঁর অধীন মাত্র ৫০ শিক্ষার্থী এমফিল ডিগ্রি লাভ করেছেন। আর ৩৩ জন পেয়েছেন পিএইচডি ডিগ্রি! তাঁদের প্রত্যেকের কাজই আন্তর্জাতিক মানের।

মনে রাখতে হবে, যে সময়ে জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর এই শিক্ষার্থীদের আন্তর্জাতিক মানের গবেষণায় অনুপ্রাণিত করেছেন, তখন এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই অর্থে ভালো মানের ইন্টারনেট–সংযোগই ছিল না।

ছাত্রছাত্রীদের অনুপ্রাণিত করা, তাঁদের অভিভাবক হওয়ার পরও জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর নিজের গবেষণা ও কাজের সময়টুকু ঠিকই বের করে নিতেন। ১৯৯২ সালে তাঁর ‘অ্যান ইন্ট্রোডাকশন টু ম্যাথেমেটিক্যাল কসমোলজি’ বইটি প্রকাশিত হয়। এরপর লিখেছেন ‘ফার ফিউচার অব দ্য ইউনিভার্স’। তবে জামাল স্যারের সবচেয়ে বিখ্যাত বইটি হলো ‘দ্য আলটিমেট ফেট অব দ্য ইউনিভার্স’। ১৯৮৩ সালে কেমব্রিজ প্রেস থেকে প্রকাশের পর এটি ফরাসি, পর্তুগিজ, যুগোস্লাভ ও জাপানি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বইটি তাঁর নিজের গবেষণার সারাংশ। গবেষণার সন্দর্ভ হাতে পাওয়ার পর বিশিষ্ট পদার্থবিজ্ঞানী ফ্রিম্যান ডাইসন তাঁর মতো মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কে আকৃষ্ট হন।

জামাল স্যারের মৃত্যুর পর ফ্রিম্যান ডাইসন স্মরণ করেছেন, ‘জামাল নজরুল ইসলামের কাজ আমাকে মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কে ভাবতে উদ্বুদ্ধ করেছে। জামাল ইসলাম সেই কাজটাই করেছেন, যা কিনা অনেকেই করতে চান না। কারণ, কাজটা কঠিন।’

মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য অনেকগুলো ঘটনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া লাগে। প্রোটন কণার লয় থেকে দুনিয়ার তাপীয় মৃত্যু। এখনো বিজ্ঞানীরা মহাবিস্ফোরণ থেকে এ মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে বলে বিশ্বাস করলেও এর শেষ পরিণতি কী হবে, সেটা নিয়ে নিশ্চিত হতে পারেননি। প্রসারণ দিয়ে যার শুরু, সংকোচন দিয়ে তার শেষ কি না, কে জানে। তবে জামাল নজরুল ইসলাম দেখিয়েছেন, শেষের দিকে এক মহাশূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে।

যে গুটিকয়েক বিজ্ঞানী মহাবিস্ফোরণ তত্ত্বের বিপরীতে ‘স্টেডি স্টেট থিউরি’ মেনে চলেন, তাঁদের অন্যতম জয়ন্ত নারলিকর, যিনি কেমব্রিজে জামাল নজরুলের সহপাঠী ছিলেন। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্বের আঙিনায় তখন একঝাঁক তরুণ-তরুণীর বিচরণ, যাঁদের অনেকেই পরে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন।

বিকেল হলে জামাল-সুরাইয়া দম্পতি তাঁদের দুই কন্যা সাদাফ আর নার্গিসকে নিয়ে হাঁটতে চলে যান নদীর পাড়ে। কোনো কোনো দিন সঙ্গী হন স্টিফেন আর জেন হকিং, সঙ্গে তাঁদের পুত্র রবার্ট আর কন্যা লুসি। আলোচনায় সৃষ্টিতত্ত্ব যেমন আসে, তেমনি আসে প্রকৃতির কথাও। প্রকৃতির সত্য উদ্‌ঘাটন করতে হলে প্রকৃতিকে নিজের মতো করে জানা দরকার। এই বোধ থেকে অধ্যাপক জামাল নজরুল ইসলাম তাঁর মেয়েদের প্রকৃতি পাঠে উৎসাহ দিতেন।

দেশে ফিরবেন—এ পরিকল্পনা তাঁর শুরু থেকেই ছিল। তাই ঠিক সময়ে মেয়েদের বাংলা শেখানো শুরু করেন, সঙ্গে গানবাজনা। আইনস্টাইনের জগতের মানুষটি পিয়ানো ও সেতার বাজাতে পারতেন চমৎকার। চট্টগ্রামে তাঁর সাব-যা-যার বাসায় নিয়মিত হতো গানের আসর। কখনো কখনো জামাল স্যার বসে পড়তেন হারমোনিয়াম নিয়ে। স্ত্রী সুরাইয়া ইসলামও গলা মেলাতেন তাঁর সঙ্গে।

বিজ্ঞানের গবেষণা ছাড়াও অর্থনীতি আর সমাজসংস্কারের বিষয়টিকেও শেষ জীবনে প্রাধান্য দিয়েছেন। বিশ্বাস করতেন, পশ্চিমাদের প্রেসক্রিপশনে আমাদের মুক্তি নেই। উন্নত বিশ্বের প্রতি তাঁর একটাই অনুরোধ ছিল, ‘তোমরা শুধু আমাদের পথ থেকে সরে দাঁড়াও, আমাদের ভালোমন্দ আমাদেরই ভাবতে দাও।’

আর বিশ্বাস করতেন নতুন প্রজন্ম ঠিকই পথ বের করে ফেলবে। তাই নতুনদের প্রায় সব কিছুতেই তাঁর সমর্থন থাকত। আমরা যখন গণিত অলিম্পিয়াড শুরু করি, এমনকি যখন আমাদের কমিটিও হয়নি, তখন থেকে তিনি আমাদের পরামর্শ দিয়েছেন। আমৃত্যু ছিলেন আমাদের গণিত অলিম্পিয়াড কমিটির সদস্য।

দেশের শিক্ষার্থীদের যদি বেশি বেশি করে আমরা গণিত আর বিজ্ঞানের শিক্ষায় অনুপ্রাণিত করতে পারি, তাহলেই কেবল এই বড় মাপের বিশ্ববিজ্ঞানীর প্রতি আমাদের প্রকৃত শ্রদ্ধা জানানো সম্পন্ন হবে।

* জামাল নজরুল ইসলাম, জন্ম: ২৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯, মৃত্যু: ১৬ মার্চ ২০১৩