সমস্যা ও সংকটে মা–বাবাকে সন্তানের পাশে থাকতে হবে

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল পরামর্শ সহায়তা সভায় বক্তব্য দেন। পাশে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেখলা সরকার। ঢাকা, ২ আগস্ট
ছবি: প্রথম আলো

সন্তানের বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নানা সমস্যা ও সংকট তৈরি হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে সন্তানের মনকে বুঝতে হবে, তাদের কষ্টকে অনুধাবন করতে হবে। সন্তান কোন ধরনের সমস্যা বা সংকটে পড়েছে, সেই সমস্যা কীভাবে দেখছে, সেটি শুনতে হবে। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে দোষারোপ না করে তার পাশে থাকতে হবে। এতে সন্তান একাকী হয়ে পড়বে না। তার মনে হবে মা–বাবা তার পাশে আছে। এর মধ্য দিয়ে সন্তান খুব সহজেই সমস্যা বা সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারবে এবং আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে উঠবে।

আজ শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলোর কার্যালয়ে আয়োজিত ‘সন্তানের মনের সংকটে অভিভাবকের করণীয়’ শীর্ষক পরামর্শ সহায়তা সভায় অভিভাবকদের এসব পরামর্শ দিয়েছেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল ও মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেখলা সরকার।

প্রথম আলো ট্রাস্টের পক্ষ থেকে এই পরামর্শ সহায়তা সভার আয়োজন করা হয়। প্রথম আলো ট্রাস্ট নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শ সভার আয়োজন করে থাকে। এটি ছিল ১৭১তম পরামর্শ সহায়তা সভা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। পরামর্শ সহায়তা সভায় অভিভাবকদের কাছ থেকে সন্তানের সমস্যা ও নানা সংকটের কথা শোনেন দুই মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। তারপর এসব সমস্যায় মা–বাবার আচরণ কেমন হবে, সে বিষয়ে তাঁরা বিভিন্ন পরামর্শ দেন।

সভায় মোহিত কামাল বলেন, অনেক সময় অভিভাবকেরা শিশুসন্তানের আবেগ ও চাহিদাকে অনুধাবন করেন না। সন্তানেরা যেসব সমস্যা মোকাবিলা করছে, সে বিষয়ে আলোচনা করেন না। অনেক সময় শিশুসন্তান পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারে না। কখনো কখনো তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হলে ‘আইডেন্টিটি ক্রাইসিস’ তৈরি হয়। এতে শিশুর ব্যক্তিত্বের মধ্যে নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য ঢুকে যায়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, শিশুটি পরিবার থেকে দূরে চলে গেলে আত্মবিশ্বাস কমে যায়। আত্মবিশ্বাস ও আত্মপ্রত্যয়ের অভাব হলে শিশুর মধ্যে বেপরোয়া একটি ভাব বা বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে।

এ ক্ষেত্রে অভিভাবকদের করণীয় কী হবে, এ বিষয় নিয়ে পরামর্শও দিয়েছেন মোহিত কামাল। তিনি বলেন, সন্তানের সঙ্গে পরিবারের সবার একটি ভালো যোগাযোগ গড়ে তোলার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। নানা বিষয় নিয়ে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করবে, মতামত দেবে। সেখানে সন্তানদেরও মতামত থাকবে এবং সেই মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। এতে সন্তান আত্মবিশ্বাসী হবে। আর আত্মবিশ্বাসী হলে তার ব্যক্তিগত নানা দক্ষতার উন্নতি ঘটবে। যদি সন্তানের মতামত না নিয়ে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন সন্তান বেপরোয়া ও বিধ্বংসী আচরণ করে।

‘সন্তানের মনের সংকটে অভিভাবকের করণীয়’ শীর্ষক পরামর্শ সহায়তা সভার আয়োজন করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ঢাকা, ২ আগস্ট
ছবি: প্রথম আলো

সন্তানের মনে সংকট দূর করতে অভিভাবকদের ভূমিকা কেমন হবে, এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মেখলা সরকার। তিনি বলেন, শিশুর মানসিক গঠন এবং বিকাশের বিষয়টি নির্ভর করে অভিভাবকেরা শিশুটির সঙ্গে কেমন আচরণ করছে। শিশুর কোন আচরণে মা–বাবা মনোযোগ দিচ্ছে, কোন আচরণে অবজ্ঞা করছে, সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সন্তান অসীম সম্ভাবনা নিয়ে জন্ম নিলেও, সেই সম্ভাবনা কতটা কাজে লাগাতে পারে, সেটি অনেকাংশে মা–বাবার ওপর নির্ভরশীল। সন্তানকে মানসিক গঠন শক্তিশালী করতে হলে মা–বাবাকে সঠিক ভূমিকা নিতে হবে।

মেখলা সরকার বলেন, সন্তানকে কঠোর অনুশাসনের মধ্যে রাখলে, তার মানসিক বিকাশে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। আবার সন্তানকে অতিরিক্ত প্রশ্রয় দিলেও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়তে পারে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি হতে পারে। আবার সন্তানকে একেবারে স্বাধীনভাবে চলাফেলা করতে দিলে, খোঁজ না রাখলে ভবিষ্যৎ সংকট মোকাবিলা করার সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে সন্তানকে কঠোর অনুশাসনে না রেখে তার মতামত শুনতে হবে। তার প্রয়োজনটা অভিভাবকদের বুঝতে হবে। তার প্রয়োজনীয় চাহিদা পূরণ করতে হবে। তবে অযৌক্তিক চাহিদা পূরণ করা যাবে না।

পরামর্শ সভায় একাধিক অভিভাবক সন্তানের মুঠোফোন আসক্তির বিষয়ে পরামর্শ চেয়েছেন। এ ক্ষেত্রে মোহিত কামাল বলেন, সন্তানের মুঠোফোন আসক্তি থেকে বের করে আনতে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে হবে। প্রয়োজনে বাসায় ছোট পাঠাগার গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি সন্তানকে খেলাধুলার সময় দিতে হবে। ঘুরতে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে।

মেখলা সরকার বলেন, মুঠোফোন থাকলে বইয়ের প্রতি শিশুরা আগ্রহী হবে না। শিশু বয়সে কোনটা সঠিক, কোনটি ভুল—এই জ্ঞান থাকে না। এই সময়টা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে পরিবারের কিছু নিয়মকানুন চালু থাকতে হবে। মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। এটা সন্তান মানতে চাইবে না, তবে একটা পর্যায়ে মেনে নেবে। সমস্যার সমাধান না হলে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হবে।