আলোচনায় শীর্ষে মসিউর রহমানসহ পাঁচজন

পরবর্তী রাষ্ট্রপতি কে হচ্ছেন, এ নিয়ে নানা আলোচনা চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। আওয়ামী লীগের মনোনয়নের দিকে সবার নজর।

বঙ্গভবন
ফাইল ছবি

ফেব্রুয়ারির মধ্যেই দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে। সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় রাষ্ট্রপতি হবেন আওয়ামী লীগের—এটা নিশ্চিত। ফলে রাষ্ট্রপতি পদে কে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাচ্ছেন, সেটাই আলোচনার মূল বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় দলের ভেতরের খবর হচ্ছে—কয়েক মাস ধরে ডজনের বেশি ব্যক্তির নাম আলোচনায় ছিল। এখন তালিকা সংক্ষিপ্ত হয়ে চার–পাঁচজনে নেমে এসেছে। এর মধ্যে শীর্ষে আছে মসিউর রহমান, শিরীন শারমিন চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, আনিসুল হক ও বিচারপতি খায়রুল হকের নাম।

সংসদীয় গণতন্ত্রের যুগে ১৯৯১ সালের পর আর কখনো রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটের প্রয়োজন হয়নি। বরাবরই ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হয়ে আসছেন। এখন নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ঘিরে সংসদে প্রতিনিধিত্বশীল অন্যান্য দল থেকে রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী দেওয়ার কোনো আলোচনা নেই। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মানেই নিশ্চিত রাষ্ট্রপতি।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, যেসব নাম নিয়ে দলে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে, সেগুলো খসড়া বলা চলে। চূড়ান্ত একজনকে বাছাই করবেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি এখনো নিজের পছন্দের কথা প্রকাশ করেননি।

তবে দলের নেতাদের কেউ বলছেন, সক্রিয় ও পরীক্ষিত রাজনীতিক এবার রাষ্ট্রপতি হবেন। কারও মতে, উপদেষ্টা পরিষদ থেকে হচ্ছেন রাষ্ট্রপতি। কেউ কেউ মনে করেন, এবার একজন নারীকে রাষ্ট্রপতি করা হতে পারে।

জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনসহ মোট আসন ৩৫০টি। আওয়ামী লীগের মোট আসন ৩০২টি, জাতীয় পার্টির ২৬টি, ওয়ার্কার্স পার্টির ৪টি, জাসদের ২টি, গণফোরামের ২টি, বিকল্পধারার ২টি, তরিকত ফেডারেশনের ১টি ও জেপির ১টি আসন রয়েছে। এ ছাড়া স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য রয়েছেন তিনজন। বিএনপির সাতজন সংসদ সদস্য পদত্যাগ করায় এখন সংসদে দলটির কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। সংসদে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা রাষ্ট্রপতি পদে কোনো প্রার্থী দেবেন না। ফলে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীর দিকেই সবার নজর।

রাষ্ট্রপতির কোনো নির্বাহী ক্ষমতা নেই। তাই অনেকেই পদটিকে ‘আলংকারিক’ হিসেবে আখ্যা দেন। তবে রাজনৈতিক সংকট কিংবা নির্বাচনের সময়ে রাষ্ট্রপতি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেন। সে কারণে আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এবার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন আলোচনায় গুরুত্ব পাচ্ছে।

বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২০১৮ সালের ২৪ এপ্রিল দ্বিতীয় মেয়াদের শপথ গ্রহণ করেন। আগামী ২৩ এপ্রিল তাঁর পাঁচ বছরের মেয়াদকাল শেষ হচ্ছে।

সংবিধান অনুসারে, একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ দুবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন। মেয়াদ অবসানের পূর্ববর্তী ৯০ থেকে ৬০ দিনের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নিয়োগ দিতে হবে। সে হিসাবে আগামী ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহের মধ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করতে হবে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী আবদুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, রাষ্ট্রপতি পদে কে আসতে পারেন, এ বিষয়ে কাজ করছেন দলীয় সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সর্বজনশ্রদ্ধেয় ব্যক্তিকেই রাষ্ট্রপতি করা হবে। তিনি বলেন, ফেব্রুয়ারির শুরুতেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

রাষ্ট্রপতি পদে যাঁদের নাম আসছে

আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, দলটির নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ নিজেই রাষ্ট্রপতি আসনে বসতে চাইছেন। কেউ কেউ নিজের পছন্দের লোকদের নাম ঘনিষ্ঠ মহলে ছড়িয়ে দলীয় প্রধানের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করছেন। এই প্রক্রিয়া চলছে মাস ছয়েক ধরে। ফলে এর মধ্যে ডজনখানেক নেতা, আমলার নাম আলোচনায় এসেছে।

আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে রাষ্ট্রপতি পদে চার-পাঁচটি নাম বেশি আলোচনায়। এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান, চট্টগ্রাম–১ আসনের সংসদ সদস্য মোশাররফ হোসেন, স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মধ্যে যে কেউ বসতে পারেন রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে।

মাস দুয়েক আগে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ও সাবেক মন্ত্রী মোস্তাফিজুর রহমানের নামও আলোচনায় ছিল। এখন সেই আলোচনা অনেকটা কমে গেছে।

ওবায়দুল কাদেরকে নিয়েও কিছুদিন আলোচনা ছিল। তিনি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার পর সেই আলোচনা আর নেই। সম্প্রতি ওবায়দুল কাদের প্রথম আলোকে বলেছেন, তিনি এখনো রাষ্ট্রপতি পদের জন্য যোগ্য নন।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হকও রাষ্ট্রপতি পদে বিবেচনায় থাকতে পারেন, এই ধারণা আছে আওয়ামী লীগের নেতাদের অনেকের। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নামও আলোচনায় আছে।

সরকার ও দলের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রক্রিয়ার সঙ্গে নানা সময় যুক্ত ছিলেন, এমন দুজন আওয়ামী লীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, সম্ভাবনার ক্রম করা হলে এখনো মসিউর রহমানের নাম শীর্ষে আছেন। এমনকি রাষ্ট্রপতি পদে তাঁকে বিবেচনার পর গণমাধ্যমে বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে তাঁর সম্পৃক্ততা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে তাঁর উপস্থিতি চোখে পড়ে না।

ওই নেতারা বলেন, এরপরই চট্টগ্রামের মোশাররফ হোসেনকে বিবেচনায় নেওয়া যায়। গত ২৪ ডিসেম্বর ঘোষিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতিমণ্ডলীতে শেখ হাসিনার পরই তাঁর নাম রয়েছে। আগের কমিটিতে তাঁর অবস্থান ছিল ষষ্ঠ। সাজেদা চৌধুরী ছিলেন শেখ হাসিনার পরে। সাজেদা চৌধুরী মারা যাওয়ার পর এবার তাঁকে চার ধাপ এগিয়ে আনা হয়েছে। এ থেকেও কেউ তাঁকে সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে বিবেচনা করছেন।

দলীয় সূত্র জানায়, আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে রাষ্ট্রপতি করার ব্যাপারে দলের একটা অংশ তৎপর আছে। তাদের যুক্তি হচ্ছে—আনিসুল হক আইনজ্ঞ, পারিবারিকভাবে বঙ্গবন্ধু পরিবারের ঘনিষ্ঠ।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ঘনিষ্ঠজনদের কাছে একজন নারী রাষ্ট্রপতি করার কথা বিভিন্ন সময় বলেছেন। সে হিসেবে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী আলোচনায় আছেন। এমনটা হলে দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সংসদ নেতা, সংসদের উপনেতা, বিরোধীদলীয় নেতা—সবাই হবেন নারী। এই ভাবনাকে আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন ‘চমকপ্রদ’।

তবে আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, যে নামগুলো আলোচনায় আছে, তা দলীয় সভাপতিরও বিবেচনায় আছে। তবে তিনি এখনো তাঁর মনোভাব প্রকাশ করেননি। এ মাসের শেষের দিকে চূড়ান্ত প্রার্থীর নাম জানা যাবে।

রাষ্ট্রপতির নির্বাচন যেভাবে

রাষ্ট্রপতি হওয়ার সর্বনিম্ন বয়স ৩৫ বছর, সর্বোচ্চ সীমা উল্লেখ নেই। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন সংসদ সদস্যদের ভোটে। তবে তাঁর সংসদ সদস্য হওয়ার বাধ্যবাধকতা নেই।

রাষ্ট্রপতি নির্বাচনপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের। তফসিল ঘোষণার আগে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অবশ্য জাতীয় সংসদের স্পিকারের সঙ্গে আলোচনা করে থাকেন।

১৯৯১ সালের রাষ্ট্রপতি আইন অনুসারে, ইসি ভোটার তালিকা প্রণয়ন করবে এবং যাচাই-বাছাই করবে মনোনয়নপত্র। প্রার্থী একজন হলে এবং যাচাইয়ে তার মনোনয়নপত্র বৈধ বিবেচিত হলে তাঁকে নির্বাচিত ঘোষণা করবে ইসি। একাধিক প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ হলে ভোট হবে। সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্তকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। আর সমান ভোট পেলে প্রার্থীদের মধ্যে লটারির মাধ্যমে ফল নির্ধারণ করা হবে।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা

সংবিধানে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সব ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করবেন। সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাঁকে দেওয়া ও অর্পিত সব ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করবেন। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় ও পররাষ্ট্রনীতি–সংক্রান্ত বিষয় রাষ্ট্রপতিকে অবহিত রাখবেন প্রধানমন্ত্রী। রাষ্ট্রপতি অনুরোধ করলে যেকোনো বিষয় মন্ত্রিসভায় বিবেচনার জন্য পেশ করবেন প্রধানমন্ত্রী।

এই থেকে মনে হতে পারে, রাষ্ট্রপতি অগাধ নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারী। কিন্তু আদতে তা নয়। সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফায় বলা হয়েছে, শুধু প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতির কারও পরামর্শ নেওয়ার দরকার নেই। বাকি সব দায়িত্ব পালনে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন।

এর সঙ্গে সংবিধান শর্তও জুড়ে দিয়েছে যে প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শ দিয়েছেন কি না কিংবা পরামর্শ দিয়ে থাকলে সেটা কোনো আদালত প্রশ্ন তুলতে পারবেন না।

পদটি আলংকারিক হলেও একজন রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের ভোট লাগবে। ভোটের আগে আলোচনা করে সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের একমত হতে হবে যে রাষ্ট্রপতি আইন ভেঙেছেন। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে এ কিউ এম বদরুদ্দোজা চৌধুরীকে বিএনপি অপসারণের উদ্যোগ নিলে তিনি নিজেই পদত্যাগ করেন। বর্তমানে সংসদে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা আছে। ফলে চাইলে যে কাউকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন কিংবা অপসারণ ক্ষমতাসীন দলটির জন্য কঠিন কিছু নয়।