একটি বিচ্ছেদের গল্প ও দেনমোহরের আইনি ব্যাখ্যা

প্রতীকী ছবি

বখতিয়ার উদ্দিন (ছদ্মনাম) একজন প্রকৌশলী এবং ইশানা হক (ছদ্মনাম) একজন চিকিৎসক। তাঁরা দুজনেই নামী প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। পারিবারিক পছন্দে তাঁদের বিয়ে হয়েছিল। নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত পাত্র-পাত্রীর সেই বিয়ের অনুষ্ঠান ছিল বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। ২৫ লাখ টাকার দেনমোহর ধার্য করে কাজির মাধ্যমে বিয়ে রেজিস্ট্রি করা হয়েছিল। এ বিয়ে নিয়ে দুই পরিবারের সদস্যদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। কিন্তু এ উচ্ছ্বাস খুব দ্রুতই পরিণত হয় বিষাদে। বাসর রাতেই বখতিয়ার আর ইশানার মধ্যে মনোমালিন্য ও ঝগড়া হয়। বিয়ের পরদিন সকালেই ইশানা চলে যান বাবার বাড়ি। বখতিয়ার কয়েক দিন তাঁর স্ত্রীকে ফিরে আসার অনুরোধ করেন, তাতে সাড়া মেলেনি। মাসখানেক পরে ইশানা তালাকের নোটিশ পাঠান। এর পাশাপাশি তিনি দেনমোহরের ২৫ লাখ টাকা ও ভরণপোষণের খরচ দাবি করেন। বখতিয়ারও যৌতুক নিরোধ আইনের ৩ ধারা অনুযায়ী আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় ইশানাসহ ছয়জনকে আসামি করা হয়। ঘটনা শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়ায়।

ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কারণে নাম ও পেশা পরিবর্তন করা হলেও ওপরের ঘটনাটি একটি সত্য ঘটনা। আমাদের সমাজে প্রায় একই রকম ঘটনা আরও ঘটছে। এখন কথা হচ্ছে, এ রকম ঘটনায় আইনগত প্রতিকার কী হবে? ইশানা কি দেনমোহরের ২৫ লাখ টাকা ও ভারণপোষণের খরচ পাবেন? নাকি তিনি নিজে থেকে তাঁর স্বামীকে তালাক দেওয়ায় কিছুই পাবেন না?

আমাদের সমাজে অনেকেই মনে করেন স্ত্রী স্বামীকে তালাক দিলে তিনি কোনো প্রকার দেনমোহর বা ভরণপোষণের টাকা পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে বিষয়টি তা নয়। তালাক যে–ই প্রদান করুক না কেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুসারে স্ত্রীকে দেনমোহর ও ইদ্দতকালে ভরণপোষণের খরচ দিতে হবে। দেনমোহর বিয়ের সময় স্বামীর কাবিননামায় প্রতিশ্রুত অর্থ, যা স্বামী কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারেন না। দেনমোহর দুভাবে দেওয়া যায়। তাৎক্ষণিকভাবে অর্থাৎ বিয়ের আসরে স্ত্রীকে দেনমোহরের পুরোটা বা আংশিক দেওয়া। বিয়ের আসরে না দিতে পারলে পারিবারিক জীবন চলাকালে স্ত্রী চাওয়ামাত্র স্বামী দেনমোহর দিতে বাধ্য থাকবেন। দেনমোহর বাকি থাকলে স্বামীর মৃত্যুর পর কিংবা স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ বা তালাকের পর স্ত্রী তা পেয়ে থাকেন।

ওপরে বর্ণিত বখতিয়ার ও ইশানার ঘটনাটা একটু অন্য রকম। সে ক্ষেত্রে কী হবে? বিয়ের পর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে শারীরিক সম্পর্ক না হলে এবং কোনো কারণে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদ হলে স্ত্রীকে নির্ধারিত দেনমোহরের অর্ধেক দিতে হবে। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো প্রকার ভরণপোষণের খরচ পাবেন না। যদি দেনমোহরের পরিমাণ নির্দিষ্ট করা না থাকতো এবং সহবাসের পূর্বেই বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যেত, তাহলে কী হতো? সে ক্ষেত্রে স্ত্রী কেবল তিন সেট জামাকাপড় পেতেন। এ ছাড়া তিনি ভরণপোষণের খরচ বা অন্য কিছুই পেতেন না।

গ্রহণ না করলেও তালাকের নোটিশ কার্যকর হবে

তালাকের নোটিশ গ্রহণ করা, না করা নিয়ে আমাদের সমাজে একটি ভুল ধারণা প্রচলিত আছে। অনেকেই মনে করেন তালাকের নোটিশ গ্রহণ না করলে তা কার্যকর হবে না, বিষয়টা তেমন নয়। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের ৭(১) ধারা অনুযায়ী তালাক নোটিশ মূলত প্রদান করা হয় স্বামী বা স্ত্রীর এলাকার সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর অথবা পৌরসভার মেয়র কিংবা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানকে। স্বামী বা স্ত্রীকে নোটিশের একটি অনুলিপি পাঠানো হয়। স্ত্রী বা স্বামী তালাকের নোটিশ গ্রহণ না করলেও কাউন্সিলর বা মেয়র বা চেয়ারম্যান নোটিশ পাওয়ার ৯০ দিন পর তালাক স্বয়ংক্রিয়ভাবে কার্যকর হবে।

দেনমোহরের জন্য মামলা

বিয়ে চলমান বা তালাকের পর পারিবারিক আদালতে দেনমোহর বা ভরণপোষণের জন্য স্ত্রী মামলা করতে পারবেন। দেশের প্রতিটি জেলায় পারিবারিক আদালত রয়েছে। সমস্যা যে জেলায় সৃষ্টি হয়েছে, সেই জেলায় কিংবা স্বামী-স্ত্রী সর্বশেষ যে জেলায় বসবাস করেছেন, সেখানে অথবা স্ত্রী যে জেলায় বসবাস করছেন সেখানকার পারিবারিক আদালতে মামলা করা যাবে। যথাযথ বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে আদালত লিখিত রায় ও ডিক্রি দেবেন। আদালতের দেওয়া ডিক্রিতে বিবাদীকে যেকোনোভাবে দেনমোহরের টাকা পরিশোধের আদেশ দিতে পারেন। এটা একবারেও হতে পারে, আবার কিস্তিতেও হতে পারে। তবে বিবাদী কিস্তির মাধ্যমে টাকা পরিশোধের দাবি করতে পারবেন না। এটা আদালতের নিজস্ব বিবেচনার ওপর নির্ভর করবে। আদালতের দেওয়া ডিক্রি অমান্য করলে বিবাদীকে তিন মাস বা টাকা পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত কারাদণ্ড দিতে পারেন। সংক্ষুব্ধ পক্ষ ইচ্ছা করলে আদালতের রায়, ডিক্রি বা আদেশের বিরুদ্ধে ৩০ দিনের মধ্যে জেলা জজের আদালতে আপিল করতে পারবেন। তবে দেনমোহরের পরিমাণ পাঁচ হাজার টাকার বেশি না হলে কোনো আপিল করা যাবে না।

সোলায়মান তুষার আইনজীবী