ফেসবুক বন্ধ, ব্যবসায় মন্দা

ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করেন প্রায় ৬ লাখ উদ্যোক্তা। অনেকেই নারী। তাঁদের ক্ষতি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা।

ফেসবুকরয়টার্স

পিরোজপুরের অহিদা মনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে পিঠা বিক্রি করে আয় করেন। তা দিয়েই মেয়েকে নিয়ে তাঁর সংসার চলে।

অহিদা বলছিলেন, ইন্টারনেট বন্ধ থাকার দিনগুলোয় তিনি কোনো ফরমাশ পাননি। ১০ দিন পর গত রোববার তিনি ২০টি পিঠা বানানোর ফরমাশ পেয়েছেন। তার মাধ্যমে কিছু টাকা পেয়েছেন। ইন্টারনেট চালু হলেও ফেসবুক বন্ধ থাকায় তাঁর পিঠা বিক্রি নগণ্য পর্যায়ে নেমে এসেছে।

সরকার যে উদ্দেশ্যে ফেসবুক বন্ধ রেখেছে, তা কাজে আসছে না। বরং ব্যবসায়ীরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন।
ফাহিম মাশরুর, সাবেক সভাপতি, বেসিস

অহিদার মতো দেশের অনেক মানুষ ফেসবুকে পেজ ও গ্রুপ খুলে খাবারসহ বিভিন্ন পণ্য বিক্রি করেন। কারও কারও আয়ের একমাত্র উপায় এটি। কেউ কেউ নিজেদের দোকানের বিক্রি বাড়াতে ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন। সবাই বিপাকে পড়েছেন ফেসবুক বন্ধ থাকায়।

ফেসবুকের মাধ্যমে পণ্য ও সেবা বিক্রির ব্যবসাকে বলা হয় এফ-কমার্স। এ খাতভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের সংগঠন উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্সের (উই) তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬ লাখের মতো এফ-কমার্স উদ্যোক্তা রয়েছেন। সংগঠনটির সভাপতি নাসিমা আকতার প্রথম আলোকে বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে এফ-কমার্স খাতে ৬০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ শুরু হলে ১৭ জুলাই রাত থেকে মোবাইল ইন্টারনেট এবং ১৮ জুলাই রাতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যায়। পাঁচ দিন পর ২৩ জুলাই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ সীমিত পরিসরে ফেরে। ১০ দিন পর ২৮ জুলাই মোবাইল ইন্টারনেট চালু হয়েছে। কিন্তু বন্ধ ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম।

ফেসবুক কবে চালু হবে, তা স্পষ্ট নয়। সরকার বলছে, দেশের আইন মানতে সম্মত হলে ফেসবুক চালু হবে। অবশ্য ফেসবুক কর্তৃপক্ষ সাধারণত নিজস্ব নীতি অনুযায়ী চলে। গত রোববার ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্‌মেদ পলক ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসার ক্ষতির বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে সাংবাদিকদের বলেন, সরকার যেসব আধেয় বা কনটেন্ট সরানোর অনুরোধ করে, সে তুলনায় ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা খুব কমই সাড়া দেয়। ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে কোনো মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে ডিজিটাল কমার্স হয়ে উঠতে হবে।

অবশ্য উদ্যোক্তারা বলছেন, ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানের পক্ষে ডিজিটাল কমার্স হয়ে ওঠা কঠিন। অনলাইন দরজিবাড়ি টাইলোর উদ্যোক্তা রাসেল শেখ প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ফেসবুকে পণ্য কেনাবেচা করেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই মূলধন কম। ফেসবুকে পেজ খুলে ব্যবসা করতে টাকা লাগে না। ওয়েবসাইট তৈরি ও রক্ষণাবেক্ষণ একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার জন্য সহজ নয়।

ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) ২০২০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছিল, নারী এফ-কমার্স উদ্যোক্তাদের ৫৭ শতাংশের একক পেশা ফেসবুকে পণ্য বিক্রি। প্রায় ৩৯ শতাংশ এই ব্যবসার মাধ্যমে সংসার চালান।

পিরোজপুরের অহিদার মতো পটুয়াখালীর ফাতেমা নার্গিসের ছয় সদস্যের পরিবারও তাঁর ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা ও ছোট একটি বিউটি পারলারের আয়ের ওপর নির্ভরশীল। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পারলারে মানুষ আসছে না। ফেসবুক বন্ধ থাকায় সেখানেও কোনো আয় নেই। সাধারণ সময়ে তিনি ফেসবুকের মাধ্যমে দিনে গড়ে এক হাজার টাকার পণ্য বিক্রি করতেন।

সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ রাখলেও অনেকে ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে তা ব্যবহার করছেন। অবশ্য বহু মানুষ ভিপিএনের ব্যবহার জানেন না। ইন্টারনেটের গতিও কম।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি ফাহিম মাশরুর প্রথম আলোকে বলেন, ফেসবুকভিত্তিক উদ্যোগের সঙ্গে ২০ থেকে ২৫ লাখ মানুষ জড়িত। তাঁদের প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ক্ষতির শিকার। তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্যে ফেসবুক বন্ধ রেখেছে, তা কাজে আসছে না। বরং ব্যবসায়ীরা ভুক্তভোগী হচ্ছেন।