জলবায়ু ঝুঁকি বুঝে ঋণ দিতে হবে

‘নারীর আর্থসমাজিক ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তি: ক্ষুদ্রঋণ ও জলবায়ু সহনশীলতা পরিপ্রেক্ষিত’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে (বাঁ থেকে) এম আবদুস সালাম, মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন, হোসেন জিল্লুর রহমান ও নুজহাত জাবীন। গতকাল কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়েছবি: প্রথম আলো

‘আমি বন্যাকবলিত এলাকার মানুষ। প্রতিবছর বন্যায় ফসল নষ্ট হয়ে যায়। অনেক অভাবে দিন কাটত। সন্তানদের ঠিকভাবে খাওয়াতে পারতাম না। ২০২২ সালে ৪১ হাজার ৯০০ টাকা অনুদান পাওয়ার পর তাঁত কিনি। স্বামী–স্ত্রী একসঙ্গে কাজ শুরু করি। এখন মাসে আয় ২৫–৩০ হাজার টাকা।’

কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার মোছা. আইরিছ খাতুন এভাবেই তাঁর সচ্ছলতা ফেরার গল্প বলছিলেন। একই এলাকার এজেদা বেগম ও রমেছা খাতুন নিজেদের ক্ষমতায়ন, পরিবার ও সমাজে মর্যাদা পাওয়া, কথা বলার শক্তি পাওয়ার কথা বললেন গতকাল সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত গোলটেবিল বৈঠকে।

‘নারীর আর্থসামাজিক ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তি: ক্ষুদ্রঋণ ও জলবায়ু সহনশীলতা পরিপ্রেক্ষিত’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশ, গণ উন্নয়ন কেন্দ্র ও প্রথম আলো।

বৈঠকে বক্তারা বলেন, নদীভাঙন, বন্যা ও খরার মতো জলবাযু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকা বুঝে ক্ষুদ্রঋণ ও অনুদান বিতরণ এবং কার্যক্রম বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর নামে নেওয়া ক্ষুদ্রঋণ যেন নারীরাই ব্যবহার করতে পারেন, সেভাবে প্রশিক্ষণ ও জেন্ডার সংবেদনশীলতা তৈরি করতে হবে। প্রকল্পের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, ক্ষুদ্রঋণের সঙ্গে অনুদান ও জীবিকা নির্বাহে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা থাকলে এবং জেন্ডার সংবেদনশীল কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তা কাজে লাগালে জলবাযু পরিবর্তনের ঝুঁকিপ্রবণ এলাকার নারীদের জন্য বেশি কাজে লাগে। প্রশিক্ষণ ও সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডগুলো নারীর অংশগ্রহণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও ক্ষমতায়ন বাড়াতে অবদান রাখে। বক্তারা ক্ষুদ্রঋণ ও অনুদানের যথাযথ ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে একটি দৃঢ় ধারণা রয়েছে যে নারীর ক্ষমতায়নে অনেক অর্জন হয়েছে। কিন্তু এ নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কিছু নেই। এখনো অনেক কিছু করার বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষুদ্রঋণের মূল উদ্দেশ্য ছিল, প্রান্তিক নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য বিমোচন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে যাঁরা সফল হবেন, তাঁদের আরও উন্নয়নে শুধু সহায়তা করলে হবে না। যাঁরা সফল হতে চান, কিন্তু অতিরিক্ত আরও সহায়তা দরকার, তাঁদের কথাও মনে রাখতে হবে।

পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে ঋণের পাশাপাশি অনুদান দেওয়া যেতে পারে বলে মনে করেন হোসেন জিল্লুর রহমান। তিনি বলেন, সে ক্ষেত্রে এ অনুদান আসতে পারে তিন জায়গা থেকে—বৈশ্বিক জলবায়ু তহবিল, ক্ষুদ্রঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের সামাজিক দায়বদ্ধতা খাতে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দ করা অর্থ ও জাকাত তহবিল। তিনি আরও বলেন, ঋণ ও অনুদান শুধু পরিবারগুলোকে দেওয়া হচ্ছে। কমিউনিটি পর্যায়েও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য ঋণ ও অনুদান দিতে নজর দেওয়া দরকার।

দেশের বেসরকারি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রক সংস্থা মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটির (এমআরএ) নির্বাহী ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন ঢাকার বাইরে তাঁর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ৬৮ ক্ষুদ্রঋণগ্রহীতা নারীর কাছে তিনি জানতে চেয়েছিলেন, কতজন নিজের নামে তোলা ঋণ নিজেরা কাজে লাগিয়েছেন। মাত্র ১১ জন হাত তুলেছিলেন। বাকি ৫৭ জনকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, দ্বিতীয়বার ঋণ পাওয়ার সুযোগ পেলে তাঁরা নিজের নামে নেওয়া ঋণ নিজেরা ব্যবহার করবেন কি না। তখন হাত তুলেছিলেন ১৭ জন, অর্থাৎ বাকি ৪০ জন নিজের ঋণ নিজে ব্যবহার করার প্রয়োজনবোধ করছেন না বা তাঁদের স্বতন্ত্রভাবে কিছু করার সুযোগ তৈরি হয়নি। সেই সুযোগ তৈরি করা দরকার। জলবায়ু পরিবর্তজনিত কারণে ঝুঁকির সম্মুখীন হওয়া দরিদ্র পরিবারগুলোর ওপর ঋণের কিস্তি পরিশোধের চাপ কমাতে অনুদান দেওয়া যেতে পারে।

সূচনা বক্তব্যে ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর নুজহাত জাবীন বলেন, প্রকল্পের শিক্ষা থেকে কীভাবে সামনে এগোনো যেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা করা দরকার। ক্ষুদ্রঋণ ও অনুদানের পাশাপাশি যদি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাতে কম বিনিয়োগে বেশি লাভ হয়। দরিদ্র পরিবারটি বুঝতে পারে তারা কোন পরিস্থিতিতে কী করবে। খরা, বন্যা, নদীভাঙন— জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে একেক এলাকায় একেক রকম পরিস্থিতি হয়। ফলে সব এলাকার জন্য একই রকম ব্যবস্থা প্রযোজ্য নয়।

সমাপনী বক্তব্যে গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রধান এম আবদুস সালাম বলেন, প্রকল্পে যাঁদের নিয়ে কাজ করা হয়েছে, তাঁরা কোনো না কোনো সময় ঋণ নিয়েছিলেন। যেহেতু তাঁরা দুর্যোগের শিকার হন, তাই অনেক ক্ষেত্রেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন না, ক্ষতির সম্মুখীন হন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ওই জনগোষ্ঠীকে অনুদান দেওয়া হয়েছে, প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্প থেকে পাওয়া এসব অভিজ্ঞতার তথ্য নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যাওয়া দরকার, যাতে তাঁরা সেভাবে পরিকল্পনা নিয়ে বিনিয়োগ করেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, একজন নারী নিজের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যেন সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, সেই বার্তা ছড়াতে হবে। ঋণ–অনুদান দিয়ে এমন কোনো কাজে যুক্ত করা উচিত হবে নয়, যা নারীকে ঘরে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। জনপরিসরে নারীর দৃশ্যমান হওয়া বাড়াতে হবে।

ওপরে উল্লিখিত ওই তিন নারী ‘জেন্ডার ট্রান্সফরমেটিভ ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট মাইক্রোফিন্যান্স প্রজেক্ট’ (জেন্ডার রূপান্তরমূলক জলবায়ু সহনশীল ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্প) আওতায় অনুদান পাওয়া। ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের সহায়তায় এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে গণ উন্নয়ন কেন্দ্র। মডেল প্রকল্পটির আওতায় ‘ইন দেয়ার লাইফটাইম’ (আইটিএল) শিরোনামে ঋণ ও অনুদান পাওয়া নারীদের আর্থিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার তথ্য তুলে ধরেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক চাঁদ মিয়া। তিনি বলেন, এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত জরিপটি করা হয়। এতে প্রশিক্ষণ, ঋণ ও অনুদান সহায়তা পাওয়া ৩৪৩ নারী-পুরুষ অংশ নেন। জরিপে দেখা গেছে, ঋণ ও অনুদান পাওয়া অর্থ দিয়ে নারীদের প্রায় ৮৭ শতাংশ ছোট ব্যবসা শুরু করেছেন। ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কেউ একটি, কেউ একাধিক কাজে যুক্ত হয়েছেন। ৪৮ শতাংশ হাঁস–মুরগি, পশু পালনে, ৪৬ শতাংশ ছোট ব্যবসা এবং প্রায় ৪৩ শতাংশ কৃষিকাজে যুক্ত হয়েছেন। তাঁদের আর্থিক ব্যবস্থাপনা ও সঞ্চয়, যে কাজ করছেন সে বিষয়ে জ্ঞান বেড়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রত্যাশিত পদক্ষেপ বিশেষজ্ঞ (অ্যান্টিসিপেটরি অ্যাকশন স্পেশালিস্ট) নিগার দিল নাহার বলেন, কৃষি, হাঁস–মুরগি ও পশু পালন ইত্যাদির মতো গতানুগতিক কাজের বাইরে ভিন্ন ধরনের কাজে নারীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার। যাতে দুর্যোগের শিকার হওয়ার পর একটি কাজে ব্যর্থ হলে অন্য কাজে যুক্ত হওয়ার মতো দক্ষতা থাকে নারীর।

গণ উন্নয়ন কেন্দ্রের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক মো. মুনীর হোসেন প্রকল্প সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরেন। আরও বক্তব্য দেন সিপিআরডির প্রধান নির্বাহী মো. শামছুদ্দোহা, স্ট্রমী ফাউন্ডেশনের কান্ট্রি ডিরেক্টর মিজানুর রহমান ভূঁইয়া, সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট ইনোভেশন অ্যান্ড প্র্যাকটিসেসের (সিডিআইপি) নির্বাহী পরিচালক মিফতা নাইম হুদা, ‘মমতা’র পরিচালক তৌহিদ আহমেদ, ক্রিশ্চিয়ান এইড বাংলাদেশের কর্মসূচি সহায়তা কর্মকর্তা ছন্দা রানী, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের সমন্বয়কারী শারমিন নাহার নীপা।

গোলটেবিল বৈঠকটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।