তিন মেয়েকে হারিয়ে ঘরে আর পা দেননি তাঁরা

এই ঘরে দগ্ধ হয়ে একে একে বিদায় নিল তিন বোন। দুর্ঘটনার পর থেকে ঘরে আর পা দেননি আরতি–মিঠুন দম্পতি
ছবি: প্রথম আলো

পাথরঘাটা বান্ডেল সেবক কলোনির সামনে আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে একটি শববাহী গাড়ি ঘিরে মানুষের জটলা। কলোনিতে ঢোকার মুখে ছোট একটি আঙিনা। সেখানে একদল নারী বিলাপ করেই চলেছেন। তাঁদের মাঝখানে একজন বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন। তিনি শববাহী গাড়িতে থাকা নিথর হ্যাপির মা আরতি দাস।

ছয় বছরের হ্যাপি দাসের শেষযাত্রা উপলক্ষে এই জটলা। আঙিনার তিন পাশে বহুতল তিনটি ভবন। ভবনের প্রতিটি বারান্দায় শিশু, কিশোর ও নারী অশ্রুভেজা। হ্যাপিদের এমন চলে যাওয়া কলোনির কেউ যেন মেনে নিতে পারছেন না। হ্যাঁ, হ্যাপিসহ তিন বোন এক এক করে চলে গেল মাত্র ১৯ দিনে। অগ্নিদগ্ধ হয়েছিল তারা।

হ্যাপির আগে ৩০ জুন বড় বোন সারথী দাস (১৫) চলে যায়। তার আগে ২৪ জুন একই পরিণতি বরণ করে মেজ বোন সাকসি দাস (১১)। চার বোনের মধ্যে এখন তিন বছরের সুইটি কেবল বেঁচে আছে। একে একে তিন সন্তানের এভাবে চলে যাওয়া মানতেই পারছেন না মা আরতি ও বাবা মিঠুন দাস!

আরতি ও মিঠুন দুজনই সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতাকর্মী। তা–ও অস্থায়ী। মিঠুন কাজ করেন ২২ নম্বর ওয়ার্ডে আর আরতি ৮ নম্বর ওয়ার্ডে ডোর টু ডোর ময়লা সংগ্রহ করেন। সেই ময়লা সংগ্রহ করতে যাওয়াই যেন কাল হয়েছে তাঁদের। গত ২০ জুন ভোরে মিঠুন ও আরতি চার মেয়েকে ঘরে রেখে কাজে গিয়েছিলেন। এর মধ্যে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে ঘরের ভেতরে বিকট শব্দে আগুন ধরে যায়। সেদিন থেকে দগ্ধ চার মেয়েকে নিয়ে শুরু হয় মা–বাবার দৌড়ঝাঁপ। গতকাল বুধবার ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় হ্যাপির চলে যাওয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয় এই যুদ্ধ।

কোনো সান্ত্বনাই শান্ত করতে পারছে না মা আরতিকে
ছবি: প্রথম আলো

হ্যাপির শবযাত্রার আয়োজন চলছে। বাবা মিঠুন দাস আঙিনার পাশে একটা চেয়ারে বসে নীরবে কাঁদছিলেন। একটু সামলে নিয়ে ঘটনার দিনে ফিরে গেলেন তিনি, ‘সেদিন আমরা ভোর সাড়ে পাঁচটায় বের হয়ে যাই। ৬টা ৪০ মিনিট নাগাদ ফোন পাই। চলে যাই মেডিকেলে। সেখানে চার মেয়েকে দগ্ধ অবস্থায় দেখি। ছোটটি সামান্য চিকিৎসায় সুস্থ হয়। সাকসি এখানে মেডিকেলে মারা যায়। বাকি দুজনরে ঢাকায় নিয়েও বাঁচাতে পারলাম না।’

আরও পড়ুন

গ্যাসের চুলা থেকেই এই ঘটনা হয়েছে বলে দৃঢ়ভাবে জানালেন মিঠুন। কারও সঙ্গে কোনো বিরোধ কোনো নাশকতা—এমন প্রশ্নে দাঁত দিয়ে জিব কাটলেন ৩৫ বছরের এই পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বললেন, ‘কলোনিতে সবাই সবার আত্মার আত্মীয়। এমন চিন্তা মনে আসাও পাপ। বরং সবাই টাকাপয়সা দিয়ে মেয়েদের চিকিৎসার সাহায্য করেছেন।’

আশপাশের মানুষজনও এই বিয়োগান্ত ঘটনায় সান্ত্বনা দিতে ভিড় করেছেন সেবক কলোনিতে। স্থানীয় কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীও এলেন শবযাত্রায় অংশ নিতে। কয়েকজন তাঁকে নিয়ে গেলেন ঘরটি দেখাতে। একটি ভবনের পাশে ছোট সেমি পাকা ঘরটিতেই দগ্ধ হয় মিঠুনের চার সন্তান।

হ্যাপির সঙ্গে খেলত চাচাত বোন আরোশি। হ্যাপিকে নিয়ে যেতে দেখে কান্নায় ভেঙে পরে সে
ছবি: প্রথম আলো

এই ঘরটিতে মেয়েদের নিয়ে হাজারো স্মৃতি। তাই ঘরটিতে আর পা দিচ্ছেন না তাঁরা। বুধবার হ্যাপির মরদেহ নিয়ে ফিরেও ঘরে ঢোকেননি। আরতির ভাই উত্তম বললেন, ‘হয়তো এই ঘরে তাঁরা আর থাকবেনও না।’

সময় গড়িয়ে যায়। দুপুর ১২টায় শবযাত্রার জন্য প্রস্তুত হন সবাই। এবার গগনবিদারি আর্তনাদ করে উঠল যেন পুরো সেবক কলোনি। ধূপের গন্ধ আর হরি ধ্বনিতে ফুলে ফুলে ঢাকা হ্যাপির শবযাত্রা হাঁটতে শুরু করল।