আইসিইউর সামনে বাবার ২৪ ঘণ্টা, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার সামিয়াকে বাঁচিয়ে দাও...’

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় দগ্ধ হয়ে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছে। মেয়ের জন্য কাঁদছেন বাবা আবদুর রহিমছবি: আসাদুজ্জামান

মঙ্গলবার বেলা ৩টা ৫ মিনিট। জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের (আইসিইউ) ফটকের সামনে নির্বাক হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন ব্যবসায়ী আবদুর রহিম। আইসিইউর প্রধান ফটকের স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ভেতরের কিছু জায়গা দেখা যায়। আবদুর রহিমের চোখ আইসিইউর ভেতরে। তখন ভেতর থেকে একজন নার্স বের হয়ে আসেন। সামিয়ার আত্মীয়স্বজন কে আছেন জানতে চান। সামিয়ার নাম শুনে বাবা রহিম তাঁকে বলেন, ‘জি আপা, সামিয়ার লোক আছেন।’

রহিম তখন আইসিইউর সামনে থাকা তাঁর মামাকে আইসিইউর ভেতরে পাঠান। আর নিজে উৎকণ্ঠাভরা চেহারা নিয়ে আইসিইউর সামনে পায়চারি করতে থাকেন। পাঁচ মিনিট পর রহিমের মামা আইসিইউর ভেতর থেকে বের হন।

তখন আবদুর রহিম তাঁর মামার কাছে মেয়ে সামিয়ার শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার তথ্য জানতে পারেন। এ সময় আবদুর রহিম কাঁদতে থাকেন। এ সময় রহিমের দুই বন্ধু তাঁকে সান্ত্বনা দিতে থাকেন। তখন রহিম আক্ষেপ করে বলতে থাকেন, ‘আমার মা তিন বছর আগে মরে গেছেন। মারা যাওয়ার আগে মা আমাকে বলে গেছেন, রহিম রে তুই আমার সামিয়াকে দেখে রাখিস…মাগো, আমি হয়তো তোমার কথা রাখতে পারব না মা। হে আল্লাহ, তুমি আমার সামিয়াকে হায়াত দাও…।’

আইসিইউর সামনে রহিম যখন মেয়েকে নিয়ে বিলাপ করছিলেন, তখন তাঁর তিন বন্ধু তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। বন্ধুরা সান্ত্বনা দিলেও রহিম বলতে থাকেন, ‘আমি আমার মেয়েকে মাইলস্টোন কলেজের বিধ্বস্ত ভবন থেকে উদ্ধার করেছি। সেই মেয়ে আমার লাইফ সাপোর্টে।’

রাজধানীর উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ভবনে বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ইতিমধ্যে মারা গেছে ৩১ জন। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) তথ্য অনুযায়ী, এ ঘটনায় রাজধানীর ১০টি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে ১৬৫ জন।

জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন আছে মেয়ে সামিয়া। তাঁর জন্য বিলাপ করতে থাকা বাবা আবদুর রহিমকে সান্ত্বনা দেন তাঁর বন্ধুরা। মঙ্গলবার বিকেলে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে
ছবি: আসাদুজ্জামান

৮–১০টা শিশুকে উদ্ধারের পর মেয়েকে পান আবদুর রহিম

ব্যবসায়ী আবদুর রহিমের এক ছেলে ও এক মেয়ে। স্ত্রীকে নিয়ে রাজধানীর উত্তরা এলাকায় বসবাস করেন তিনি। রহিমের দৈনন্দিন রুটিন হচ্ছে ঘুম থেকে উঠে খাওয়াদাওয়া শেষে মেয়েকে মোটরসাইকেলে করে বাসা থেকে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে পৌঁছে দেওয়া। দুপুরে স্কুল ছুটি হলে রহিম আবার হাজির হন স্কুলের গেটে। রোজকার মতো রহিম সোমবার সকালে মেয়েকে স্কুলে দিয়ে আবার বাসায় চলে যান। বেলা একটার দিকে আবার মোটরসাইকেলে করে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে যান। তখন বেলা ১টা ৬ মিনিট। আবদুর রহিম মাইলস্টোন কলেজের প্রধান ফটকে মেয়েকে নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন। হঠাৎ একটি বিমান ভেতরে আছড়ে পড়তে দেখেন। এ সময় বিকট শব্দ হয়। ভবনের আশপাশে আগুনের শিখা দেখতে পান। আবদুর রহিম দেখতে পান তাঁর মেয়ের যে ভবনের যে কক্ষে ক্লাস হয়, সেখানেও আগুন। আচমকা আগুন, মানুষের চিৎকার–আহাজারি দেখে রহিমের মাথায় কেবল সামিয়ার ছবি ভেসে ওঠে।

আরও পড়ুন

রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যে জায়গাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ঠিক কাছেই শোঁ শোঁ আওয়াজ করে একটি যুদ্ধবিমান আমারই চোখের সামনে আছড়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। স্কুলে আটকে পড়া বাচ্চাদের আহাজারি আমি শুনতে পাই। তখন আমার মাথায় কেবল সামিয়া।’

রহিম বলেন, ‘দেখি আমার মেয়ের ক্লাসরুমের ভবনে আগুন জ্বলছে। এ দৃশ্য দেখে আমি ভয় পেয়ে যাই। তখন আমি দৌড় দিয়ে আমার মেয়ে যে ভবনে ছিল, সেই ভবনের কাছে যাই। সামনের অংশে আগুন ছিল অনেক বেশি। পরে পেছন দিয়ে ভবনের ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করি। তখন সেখানে টিনের বেড়া ছিল। সেই বেড়া টপকে আমি সেনাসদস্যদের সহায়তায় দোতলায় উঠে যাই।’

রহিম আরও বলেন, ‘আমি দোতলায় দেখতে পাই, বাচ্চাদের আগুন ঘিরে ধরেছে। বাচ্চাদের বাঁচাও, বাঁচাও চিৎকার। আমি যাকে সামনে পেয়েছি, সেখান থেকে উদ্ধার করেছি। অন্তত আট থেকে দশটা বাচ্চা আমি উদ্ধার করি। তখন আমার সামিয়াকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। পরে ভবনে আমার সামিয়াকে দেখতে পাই। সামিয়াকে সেখান থেকে উদ্ধার করে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে যাই।’

মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির শিক্ষার্থী সামিয়া জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন। হাসপাতালে মেয়ের ছবি হাতে বাবা আবদুর রহিম
ছবি: আসাদুজ্জামান

রহিমের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সামিয়ার বুক ও গলার অংশে পুড়ে গেছে।

রহিম বলেন, ‘আমার মেয়েকে উত্তরার হাসপাতালে নেওয়ার পর অবস্থার অবনতি হয়। বেলা ২টার পর সামিয়াকে অ্যাম্বুলেন্সে করে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসি। সেই থেকে মেয়ে আমার আইসিইউতে।’

মেয়েকে আইসিইউতে রেখে বাবা আবদুর রহিম সোমবার বিকেল থেকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে অবস্থান করছেন। পানি ছাড়া আর কিছুই তিনি খাচ্ছেন না। তাঁর তিনজন বন্ধুও সোমবার থেকে হাসপাতালে অবস্থান করছেন।

আরও পড়ুন

বেলা ৩টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আইসিইউর প্রবেশের প্রধান ফটকের সামনে দেখা গেল আবদুর রহিম সেখানে বিমর্ষ হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর তিন বন্ধুর কাছে মেয়েকে উদ্ধার করার সেই বর্ণনা দিতে থাকেন। রহিম বলতে থাকেন, মেয়ের খুব শখ কবুতর ও মুরগি পালার। মেয়ের আবদার পূরণের জন্য রহিম কবুতর ও মুরগি রাখার ঘরও কিনেছেন।

রহিম বলতে থাকেন, ‘আমার মেয়ের সঙ্গে আমার সকালে ইশারায় কথা হয়েছে। মেয়ের চোখের দিকে আমি তাকাতে পারিনি।’ এই বাবা বলেন, ‘হে আল্লাহ, তুমি আমার সামিয়াকে বাঁচিয়ে দাও...।’

প্রায় তিন ঘণ্টা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে আবদুর রহিমকে বিলাপ করতে দেখা যায়। রহিম বিলাপ করতে থাকেন, ‘আমার কলিজার টুকরা সামিয়া…আমার সামিয়া…।’