পাঠকের ভালোবাসাই পুরস্কার

সাসটেইনেবিলিটি অ্যান্ড প্রিন্ট ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ডসে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে দুটি পুরস্কার গ্রহণ করছেন সম্পাদক মতিউর রহমান, পাশে ওয়ান-ইফরার ওয়ার্ল্ড প্রিন্টার্স ফোরামের পরিচালক ইঙ্গি রাফন ওলাফসন ও অ্যাওয়ার্ডের প্রধান জুরি গুন্ডুলা উল্লাহ (ডানে)। গত ৮ অক্টোবর রাতে জার্মানির মিউনিখ শহরেছবি: প্রথম আলো

প্রথম আলো ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল, সেদিন যে শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল, এখন তার বয়স ২৭ বছর। ভাবা যায়! আর ধরা যাক, প্রথম আলো প্রকাশের প্রথম সপ্তাহে ৭ বছরের যে শিশু গোল্লাছুটের ছবির ধাঁধা মিলিয়েছিল, এখন তার ৭ বছরের একটা সন্তান আছে। মজার কথা হলো, এমন পাঠক আমরা পাই, যিনি বলেন, ‘আমি প্রথম আলো পড়ে আসছি সেই প্রথম দিন থেকে, আমার মা–ও পড়তেন। তিনি আজ আর বেঁচে নেই। এখন আমার সন্তানেরা বড় হয়েছে, তারাও এই প্রথম আলো পড়ে। প্রথম আলো তো আমাদের পরিবারেরই একজন। এমনকি আমার নাতিও অনলাইনে প্রথম আলো পড়ছে।’

দেশে কিংবা বিদেশে, ঢাকায় কিংবা চট্টগ্রামে, রাজশাহী কিংবা যশোরে, যেখানেই যাই, কেউ না কেউ এগিয়ে আসেন, হয়তো কেউ ম্যাজিস্ট্রেট, কেউ করপোরেট অফিসার, কেউ এনজিও নেতা, কেউ অধ্যাপনা করছেন; এসে বলেন, ‘আমি তো প্রথম আলো পড়ি, শুধু তা-ই নয়, আমি বন্ধুসভার সদস্য ছিলাম।’ কেউ বলেন, ‘আমি তো আপনাদের জিপিএ–৫ সংবর্ধনায় গিয়েছিলাম।’ বিদেশ থেকে আসেন এমআইটি থেকে পাস করা উদ্যোক্তা বা বিজ্ঞানী, এসে বলেন, ‘আমি তো গণিত অলিম্পিয়াডে অংশ নিতাম, সে কারণেই আজ আমি এই জায়গায়।’

মজার কথা হলো, এমন পাঠক আমরা পাই, যিনি বলেন, ‘আমি প্রথম আলো পড়ে আসছি সেই প্রথম দিন থেকে, আমার মা–ও পড়তেন। তিনি আজ আর বেঁচে নেই। এখন আমার সন্তানেরা বড় হয়েছে, তারাও এই প্রথম আলো পড়ে। প্রথম আলো তো আমাদের পরিবারেরই একজন। এমনকি আমার নাতিও অনলাইনে প্রথম আলো পড়ছে।’

আনন্দ-বেদনার ঘটনাও ঘটে। বুয়েটের এক শিক্ষার্থী মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন, লেখাপড়া তো অনিশ্চিত হলোই, জীবনই হয়ে গেল এলোমেলো। তাঁকে নিয়ে তাঁর মা আসতেন প্রথম আলো ট্রাস্টের মাদকবিরোধী পরামর্শসভায়। শিক্ষার্থী মাদকমুক্ত হলেন। পাস করে ভালো ক্যারিয়ার গড়তে পারলেন। তাঁর মা এসে আমাদের বলেছিলেন, ‘প্রথম আলোর জন্য দোয়া করি, প্রথম আলো যেন বেহেশতে যায়।’ আবার প্রথম আলো ট্রাস্টের অদম্য মেধাবী বৃত্তি পেয়ে সমাজের সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের মেধাবী সন্তানেরা ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, সরকারি কর্মকর্তা হয়েছেন। অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে দরিদ্রতম পরিবারের প্রথম স্নাতক হিসেবে মেয়েরা চট্টগ্রামে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন। তাঁদের কেউ কেউ পড়াশোনা শেষ করে আবার প্যারিস কিংবা মন্ট্রিয়লে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন, চাকরিও করছেন।

কিন্তু সবার আগে প্রথম আলো করতে চেয়েছে সাংবাদিকতা। দলনিরপেক্ষ থাকব, স্বাধীন থাকব, জনগণের পক্ষে থাকব, সত্য কথা সাহসের সঙ্গে বলে যাব—২৭ বছর আগে থেকেই এই ছিল আমাদের নীতি। প্রথম আলো প্রকাশের আগেও গল্প আছে। আমরা আরেকটা সংবাদপত্রে ছিলাম অনেকেই। সেই পত্রিকার উদ্যোক্তা তখনকার সরকারের এমপি নির্বাচিত হলেন। আমরা ভাবলাম, আমরা তো দলনিরপেক্ষ কাগজ করতে চাই। তখনই ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়, কথা হয় ডেইলি স্টার–এর সম্পাদক মাহ্‌ফুজ আনামের মধ্যস্থতায়। আমরা আমাদের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানকে সব সময় স্মরণ করি। তিনি প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিষয়ে কোনো দিন হস্তক্ষেপ করেননি, কোনো দিনও জানতে চাননি কী ছাপা হবে বা এটা কেন ছাপা হলো। শুধু উৎসাহ দিয়ে গেছেন।

মতিউর রহমান, সম্পাদক, প্রথম আলো

আমার মনে আছে, শেখ হাসিনার সরকার সরকারি বিজ্ঞাপন তো বন্ধ করলই, বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে ফোন করে বলা হলো, প্রথম আলোয় যেন বিজ্ঞাপন না দেওয়া হয়। প্রথম আলো দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় পত্রিকা। এতে বিজ্ঞাপন না দিলে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক ক্ষতি। একজন ব্যবসায়ী তাই আপত্তি করেন। তাঁকে বলা হয়েছিল, আপনি যে সকালে অফিসে যান, রাতে বাসায় ফিরতে পারবেন, এর কি কোনো গ্যারান্টি আছে! সেই সময়ে আমি গিয়েছিলাম লতিফুর রহমানের কাছে, তিনি সব শুনে বলেছিলেন, ব্যবসায় লাভ হবে, ক্ষতি হবে, এটাই নিয়ম, এত দিন লাভ করেছেন, এখন ক্ষতি হবে, আপস করবেন না।

সবার আগে প্রথম আলো করতে চেয়েছে সাংবাদিকতা। দলনিরপেক্ষ থাকব, স্বাধীন থাকব, জনগণের পক্ষে থাকব, সত্য কথা সাহসের সঙ্গে বলে যাব—২৭ বছর আগে থেকেই এই ছিল আমাদের নীতি।

২.

সব সরকারের আমলেই প্রথম আলো ক্ষমতাবানদের বিরাগভাজন হয়েছে, আক্রমণ কিংবা দমননীতির শিকার হয়েছে। মামলার পর মামলা দেওয়া আছে আমার নামে, আমার সহকর্মীদের নামে। কারাগারে নেওয়া হয়েছে দুজন সহকর্মীকে। কিন্তু বিগত স্বৈরাচারী সরকার অনেক প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে দখল কিংবা বন্ধ করে দিতে পারলেও প্রথম আলো বন্ধ করতে পারেনি কেন? এর উত্তর হলো, এই প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক পাঠক। প্রতি মাসে যে পত্রিকার পাঠক কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেই পত্রিকা বন্ধ করার পরিণাম সরকারের জন্য ভালো হতো না। কাজেই আমাদের রক্ষা করেছে আমাদের বিপুলসংখ্যক পাঠক।

আমরা মনে করি, আমাদের এই পাঠক-সমর্থনের কারণ প্রথম আলোর দলনিরপেক্ষতা, পেশাদারত্ব, দেশপ্রেম, মানবপ্রেম ও আধুনিকতা।

বিগত স্বৈরাচারী সরকার অনেক প্রতিষ্ঠান বেআইনিভাবে দখল কিংবা বন্ধ করে দিতে পারলেও প্রথম আলো বন্ধ করতে পারেনি কেন? এর উত্তর হলো, এই প্রতিষ্ঠানের বিপুলসংখ্যক পাঠক। প্রতি মাসে যে পত্রিকার পাঠক কোটি ছাড়িয়ে যায়, সেই পত্রিকা বন্ধ করার পরিণাম সরকারের জন্য ভালো হতো না। কাজেই আমাদের রক্ষা করেছে আমাদের বিপুলসংখ্যক পাঠক।

৩.

গণতন্ত্রের জন্য স্বাধীন নিরপেক্ষ সংবাদমাধ্যমের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্রে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে চার বা পাঁচ বছরের জন্য, তাঁরা আমাদের সেবক, মালিক নন। তাঁদের ক্ষমতা অনিঃশেষ নয়, আইন ও নীতি দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য যে শাসকেরা তা ভুলে যান। তাঁরা গণতন্ত্রের বদলে নিপীড়নতন্ত্র, লুটপাটতন্ত্র, পরিবারতন্ত্র এবং দলতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পান। এই বেপরোয়া একচক্ষু দানবকে প্রতিহত করতে পারে কেবল স্বাধীন সংবাদমাধ্যম আর আইনের শাসন। প্রথম আলো সে চেষ্টাই করে। গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে চায় চোখের মণির মতো, প্রত্যেক নাগরিকের মৌলিক মানবাধিকার রক্ষার জন্য সাংবাদিকতাকে পেশাদারত্বের সঙ্গে সামনে তুলে ধরে। এ কাজে অনেক সময় বিপদ ডেকে আনে। তবু রাজা আসে রাজা যায়, দমন–নিপীড়ন সত্ত্বেও প্রথম আলো এবং সাংবাদিকতা টিকে যায়, মানুষের জয় হয়। আপনি যদি সৎ থাকেন, সত্য তথ্য–প্রমাণসহ হাজির করেন, উৎপীড়ক ক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত আপনাকে দমাতে পারে না। কাজেই সত্য তথ্য সাংবাদিকতাকে রক্ষা করে, সত্য তথ্য সাংবাদিকতার সাহসের সবচেয়ে বড় উৎস।

একজন কর্মীও যদি তাঁর কাজটুকু না করতেন, প্রথম আলো চলতে পারত না। সবাই মিলে প্রথম আলো। কিন্তু এর প্রাণ, এর আত্মা হলেন পাঠকেরা। পাঠকদের জানাই কৃতজ্ঞতা, আর সবাইকে জানাই ধন্যবাদ। আপনাদের ঋণ অপরিশোধ্য, তা কোনো দিনও শোধ হবে না।

৪.

এ বছর বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জরিপ অনুসারে, দেশের ৫৭ শতাংশ সংবাদপত্র পাঠক প্রথম আলো (ছাপা ও অনলাইন) পাঠ করেন। বিশ্বস্বীকৃতিও পেয়েছে প্রথম আলো। গত মাসে জার্মানির মিউনিখে সংবাদ প্রকাশকদের বৈশ্বিক সংগঠন ওয়ান-ইফরায় নতুন প্রজন্মের পাঠক সম্পৃক্ততা এবং ছাপা পত্রিকায় আঞ্চলিক বিজ্ঞাপনে সৃজনশীলতা—এই দুই ক্যাটাগরিতে প্রথম আলো বিশ্বসেরার পুরস্কার জেতে।

সংবাদমাধ্যমগুলোর বৈশ্বিক সংগঠন ইনমার আয়োজনে ‘ইনমা গ্লোবাল মিডিয়া অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’-এ প্রথম আলো দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের সেরা সংবাদমাধ্যম হিসেবে সর্বোচ্চ সম্মাননা লাভ করে। গত মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে এ পুরস্কার দেওয়া হয়। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ওপর ভিত্তি করে প্রতিবাদের প্রতিধ্বনি: সত্য ও দৃঢ়তায় প্রজন্মকে প্রেরণা উদ্যোগের জন্য এই স্বীকৃতি আসে। একই আয়োজনে ‘বেস্ট আইডিয়া টু এনকারেজ রিডার এনগেজমেন্ট’ শ্রেণিতেও প্রথম পুরস্কার পেয়েছে প্রথম আলো। এ ছাড়া ‘বেস্ট ইউজ অব অ্যান ইভেন্ট টু বিল্ড আ নিউজ ব্র্যান্ড’ শ্রেণিতে তৃতীয় পুরস্কার পেয়েছে।

রাজা আসে রাজা যায়, দমন–নিপীড়ন সত্ত্বেও প্রথম আলো এবং সাংবাদিকতা টিকে যায়, মানুষের জয় হয়। আপনি যদি সৎ থাকেন, সত্য তথ্য–প্রমাণসহ হাজির করেন, উৎপীড়ক ক্ষমতাও শেষ পর্যন্ত আপনাকে দমাতে পারে না। কাজেই সত্য তথ্য সাংবাদিকতাকে রক্ষা করে, সত্য তথ্য সাংবাদিকতার সাহসের সবচেয়ে বড় উৎস।

৫.

প্রথম আলোর এই স্বীকৃতি আমাদের আরও বিনয়ী করে। আমাদের আরও অঙ্গীকারবদ্ধ করে। সংবাদমাধ্যম হচ্ছে পাবলিক ট্রাস্ট। আমরা তো শুধু নিজেদের জীবন-জীবিকা সুন্দর করার ব্রত নিইনি, আমরা এই বাংলাদেশকে সুন্দর করতে চাই, নতুন প্রজন্মের জন্য একটা নিরাপদ সম্প্রীতিময় বৈষম্যমুক্ত দেশ গড়তে অবদান রাখতে চাই। তা করার জন্য আমাদের একটাই পথ, একটাই অস্ত্র, একটাই রসদ—সৎ, বস্তুনিষ্ঠ, স্বাধীন ও দলনিরপেক্ষ সাংবাদিকতা।

অনেকের মিলিত চেষ্টার ফল এই ২৭ বছরের প্রথম আলো। আবুল মোমেন আর মফিদুল হকের প্রস্তাবে ছিল নামটা—প্রথম আলো। কাইয়ুম চৌধুরী মাস্টহেডে একটা সূর্য বসিয়ে দিয়ে তাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দিলেন। লতিফুর রহমান সাহেব উৎসাহ দিলেন, বড় কাগজ করুন, বড় করে ভাবুন। দেশের মানুষ আমাদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। যে হকার ভাইটি শীতের অন্ধকার ভোরে সাইকেল নিয়ে ছুটছেন ধানখেতের পাশ দিয়ে, যে বাইন্ডার ভাই রাত জেগে কাগজ বাঁধাই করছেন, যে সাংবাদিক নিজের এলাকার প্রভাবশালীর বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করতে গিয়ে নির্যাতনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন, আমাদের প্রায় এক হাজার কর্মী, প্রথম আলো বন্ধুসভার লাখো স্বেচ্ছাসেবক, আমাদের অনলাইন, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও, প্রকাশনা, ২০০টির বেশি দেশে ছড়ানো পাঠক—সবাই মিলেই তো প্রথম আলো।

আমার সৌভাগ্য যে আমি সেই তরণির একজন সহযাত্রী। এখানে প্রথম আলোর প্রত্যেকের ভূমিকাই অপরিসীম। একটা স্ক্রু পড়ে গেলে বিমান আকাশে উড়বে না। একজন কর্মীও যদি তাঁর কাজটুকু না করতেন, প্রথম আলো চলতে পারত না। সবাই মিলে প্রথম আলো। কিন্তু এর প্রাণ, এর আত্মা হলেন পাঠকেরা। পাঠকদের জানাই কৃতজ্ঞতা, আর সবাইকে জানাই ধন্যবাদ। আপনাদের ঋণ অপরিশোধ্য, তা কোনো দিনও শোধ হবে না।