বর্তমানে সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ‘লিগ্যাল’ কার্যক্রম চলমান। এর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশ কিছু নেতিবাচক বিষয় ঘুরছে, যা সেনাবাহিনীর মনোবলকে কিছুটা হলেও স্পর্শ করেছে।
এমন সময়ে প্রথম আলোর জরিপে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা এবং আগামী নির্বাচনে সেনাবাহিনী সহযোগিতা করলে কী প্রভাব পড়বে, এসব বিষয়ে মানুষের ইতিবাচক মতামত উঠে এসেছে। এটা সার্বিকভাবে সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থার প্রতিফলন।
আমি মনে করি, এর পেছনে দুটি মুখ্য বিষয় কাজ করেছে। এক. স্বাধীনতাসংগ্রাম থেকে শুরু করে দুর্যোগ মোকাবিলা ও দেশ গঠনে ভূমিকা এবং সার্বিকভাবে নিরপেক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করে সেনাবাহিনী দেশের সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অর্জন করেছে। দুই. গত দেড় দশকে দেশের প্রায় প্রতিটি প্রতিষ্ঠান দুর্বল করা/ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। তবে সেনাবাহিনী জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে জনগণের ওপর গুলি চালাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে এবং তাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিজস্ব সাংগঠনিক বিশ্বাসযোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছে।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পর সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালনকালে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা পেলেও অত্যন্ত রক্ষণশীলভাবে দায়িত্ব পালন করছে। আমরা যদি অপারেশন ‘ক্লিন হার্টের’ সঙ্গে অথবা ১/১১-পরবর্তী সেনা মোতায়েনের সঙ্গে তুলনা করি, বিষয়টি পরিষ্কার হবে। এই রক্ষণশীলতার কারণ হলো, গত দেড় দশকে প্রায় সব বাহিনীকে দমনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, যার ফলে তাদের নিয়ে সমাজে কিছুটা আস্থার সংকটের সৃষ্টি হয়েছিল। সেনাবাহিনীর সব পর্যায়ে এ বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বন করায় এই রক্ষণশীলতা প্রতীয়মান হয়েছে। ফলে নিরাপত্তা পরিস্থিতি যেভাবে জনগণ শুরুতে আশা করেছিল, তেমন উন্নতি না হলেও একটা সহনীয় সীমানার মাঝে রাখা গেছে।
কিন্তু আসন্ন নির্বাচন নিয়ে সেনাবাহিনীকে নিরাপত্তা অঙ্গনে নির্বাচন কমিশনের সার্বিক নেতৃত্বে অতি সক্রিয় ভূমিকা রাখার প্রয়োজনীয়তা আছে। কারণ হিসেবে ছোট্ট পরিসরে সম্ভাব্য নিরাপত্তাঝুঁকি তুলে ধরছি।
চলতি নিরাপত্তা পরিস্থিতির সঙ্গে নির্বাচন-সম্পর্কিত কিছু সহিংসতা যোগ হবে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর খোয়া যাওয়া সব অস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার হয়নি। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নির্বাচন নিয়ে সম্পূর্ণ ঐকমত্য সৃষ্টি হয়নি। ইতিমধ্যে কিছু কিছু নির্বাচনী এলাকায় প্রার্থী/সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে গেছে, যা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে। দেশ ও বিদেশ থেকে অপতথ্য ও ভুয়া খবর ছড়িয়ে এবং সংখ্যালঘু কার্ডসহ আওয়ামী লীগ ও তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল গোষ্ঠী পরিস্থিতি আরও ঘোলাটে করার প্রয়াস নেবে। দেশ ও নিরাপত্তা বাহিনী যখন অভ্যন্তরীণ নির্বাচন নিয়ে মনোযোগ দেবে, দেশের দক্ষিণ-পূর্বে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও রাখাইন-সংলগ্ন সীমান্ত ঝুঁকিতে থাকবে। এ সুযোগে কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করানোর চেষ্টা হওয়ার আশঙ্কা থাকবে।
তবে সবচেয়ে মারাত্মক পরিস্থিতি হবে যদি নির্বাচন সহিংসতা, রাজনৈতিক গুপ্তহত্যা পর্যায়ে চলে যায়। সে ক্ষেত্রে কিছু দল নির্বাচন বর্জনের মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সুতরাং নির্বাচনে নিরাপত্তা পরিস্থিতি মোকাবিলায় কোনো ফাঁক রাখা যাবে না।
আমার সুপারিশ
এক. বেসামরিক আধিপত্য ও সাংবিধানিক ম্যান্ডেটের অধীনে সেনাবাহিনী নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে। গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকার ও বিশেষ করে নির্বাচন কমিশনের। সেনাবাহিনীর দায়িত্ব অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচন নিরাপত্তা পরিস্থিতি সৃষ্টি করা, যাতে নির্বাচন কমিশন তাদের প্রতিশ্রুত দায়িত্ব পালনে সক্ষম হয়। সেনাবাহিনী পরিষ্কার লিখিত আদেশের গণ্ডির মধ্যে কাজ করবে।
দুই. উদ্ভূত সব বিভ্রান্তি কৌশলগত যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদানের মাধ্যমে দূর করবে নির্বাচন কমিশন।
তিন. জাতীয় গোয়েন্দা সমন্বয় কমিটিকে নির্বাচনকালীন নির্বাচন কমিশনের আওতায় এনে সব গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিরাপত্তাঝুঁকির আগাম ব্যবস্থা নিতে নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে।
চার. নির্বাচনকালীন দেশের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকায় মোতায়েন করা নিরাপত্তা বাহিনী দায়িত্ব অন্যত্র প্রেরণ করার বিষয়ে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে।
পাঁচ. নির্বাচনের আগে অস্ত্র উদ্ধার অভিযান পরিচালনার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন বিবেচনা করতে পারে, যা ‘ডিটারেন্ট’ (প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা অর্থে) হিসেবে কাজ করবে বলে মনে করি।
লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. মাহফুজুর রহমান সাবেক প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার, বাংলাদেশ আর্মড ফোর্সেস ডিভিশন