বাবাকে নিয়ে গল্প

প্রিয় পাঠক, এখন থেকে আমরা নিয়মিত আপনার লেখা ছাপাতে চাই। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনে ঘটা বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। দেশে থাকুন কি বিদেশে—নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]

মাকে নিয়ে সংগত কারণেই শতসহস্র গল্প-কবিতা লেখা হয়েছে। আমরা পড়েছিও। কিন্তু বাবাকে নিয়েও যতটা হতে পারত, তার কিছুই হয়নি। আজ আমি বাবাকে নিয়ে বলব।

আমার বাবা তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছেন। কিন্তু আমার পড়াশোনার ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। আমাকে সব সময় বলতেন, পড়াশোনাটা ঠিকমতো করতে হবে। নইলে তাঁরই মতো আজীবন শ্রমিকের বিধিলিপি মেনে নিতে হবে।

২০০৫ সালে এসএসসি পাস করে আমি যখন ঢাকায় পড়তে যেতে চাইলাম, তিনি এককথায় রাজি হয়ে গেলেন। অথচ মাঠে সারা দিন কৃষিশ্রমিকের কাজ করে সে সময় দিন শেষে তাঁর মজুরি ১৮০ থেকে ২০০ টাকা। সেই টাকা দিয়ে তাঁকে সংসার টানতে হয়, ঋণের কিস্তি সামাল দিতে হয়। সেসব চাহিদা পূরণ করে হাসিমুখে তিনি আমার পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গেলেন।

২০০৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার সময় নির্দ্বিধায় কয়েক লাখ টাকা খরচ করেছেন। এত যে কষ্ট তিনি করেছেন, কোনো দিন সেটা টের পেতে দেননি। কখনো অভাব বুঝতে দেননি, নিজে কৃষক হওয়া সত্ত্বেও আমাকে কোনো দিন মাঠে কাজ করতে দেননি।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শীতাতপনিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে ক্লাস করার সময় বাবার কাছে মনটা ছুটে যেত। বুকটা হু হু করে উঠত। একটা কথাই মনকে আচ্ছন্ন করে রাখত, এই কাঠপোড়ানো রোদে আমার জন্য বাবা কারও জমিতে কঠিন শ্রমে অকাতরে ঘাম ঝরাচ্ছেন। ঢাকায় মাছ-মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ার সময় গলা দিয়ে তা নামতে চাইত না। ভাবতাম, মা-বাবা হয়তো ভাত খাচ্ছেন শুধুই ডাল দিয়ে। এমন কোনো মুহূর্ত নেই, বাবাকে আমি অনুভব করিনি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি করেছি। চেষ্টা করেছি যতটা সম্ভব বাবাকে সহায়তা করার। কিন্তু সেসব ছিল তুচ্ছ। পরিস্থিতিটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। আইএলটিএস পরীক্ষা আর কোভিডের কারণে বছর দেড়েক বাড়িতে থাকতে হলো। কোনো একটা দিন তো বাবা অভিযোগ করেনইনি; বরং প্রতিদিন সকালে ২০ টাকা আর বিকেলে ২০ টাকা করে পিতৃ-তহবিল থেকে বেকার ভাতা দিয়ে গেছেন। এই সময়টা ছিল জীবনের সবচেয়ে কঠিনতম পর্ব। তবে শিখেছি অনেক। এখন মনে হয়, ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে জীবনে এ রকম কঠিন অভিজ্ঞতারও বোধ করি ভীষণ রকমের প্রয়োজন।

সেই কঠিন সময়ে আরও একজন মানুষ আমায় সাহস জুগিয়েছে। সে যদি পাশে না থাকত, হয়তো আমার ডেনমার্কে পড়তে আসাই হতো না। পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে প্রিয় মুখগুলোর মধ্যে সে–ও একজন। সেই মানুষটার কাছেও আমি কৃতজ্ঞ। সে–ও তার এমবিএ করতে নেদারল্যান্ডসে এসেছে।

যা-ই হোক, ডেনমার্কের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ এল। টাকার জন্য একটা প্রতিষ্ঠানে ঋণের আবেদন করলাম। সে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ বাবাকে ডেকে জানতে চাইল, তারা কোন ভরসায় টাকা দেবে। বাবা বললেন, ‘আমার পুলার টাকার দরকার। অবশ্যই দিবেন। সে ফেরত দিতে না পারলে আমার জমি তো আছেই।’ তাঁর কথা শুনে উপস্থিত সবার চোখ অশ্রুতে ভেসে গিয়েছিল। অথচ এই মানুষটার জন্য আমি এখনো কিছুই করতে পারিনি।

ডেনমার্কে আসার আগপর্যন্ত আমার বিছানার মশারি টানানো, গোছানো, গোসল করানো (আমি নাকি এখনো ছোট), রাতে আড্ডাবাজি করে বাড়ি ফিরলে প্রতি রাতে এক গ্লাস দুধ খাওয়ানো—সব করতেন আমার বাবা। আমি নিজেও ইচ্ছা করে এই কাজগুলো করতাম না। কারণ, এসবের মধ্য দিয়ে তৃষ্ণার্তের মতো বাবার ভালোবাসা গ্রহণ করতাম।

বাবা যখন আমাকে দুহাত দিয়ে আদর করতেন, তাঁর খেটে খাওয়া শক্ত হাতের স্পর্শ লাগত শরীরে। সেই স্পর্শের মতো কোমলতার অনুভব আমার আর কোথাও হয়নি।

আমি জানি, পৃথিবীর সব বাবাই তাঁর সন্তানকে জীবন দিয়ে ভালোবাসেন। আমার বাবা যে অবস্থান থেকে যে ত্যাগ দিয়ে আমাকে ভালোবাসা দিয়ে এসেছেন, তার বাইরে তো আমার নিজের পৃথিবী নেই। পুনর্জন্ম বলে আদৌ কিছু আছে কি না, আমি জানি না। যদি থাকে, আমি কোনো ধনীর দুলাল হয়ে নয়, এই মানুষটার সন্তান হয়েই ফিরে আসতে চাই।

  • ঝুটন চৌধুরী, ইউনিভার্সিটি অব সাদার্ন ডেনমার্ক, ডেনমার্ক