পাঠকের লেখা–২৪
চোর এল দাওয়াত খেতে
প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: [email protected]
আজ যে ঘটনাটি নিয়ে লিখছি, সেটি ঘটেছিল আমার শৈশবে। সেদিন গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় আমাদের বাড়িতে অনেক অতিথি এসেছিলেন। রাতে খাওয়াদাওয়ার পর সবাই ঘুমিয়ে পড়েন। গ্রামের রাত মানে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মধ্যরাতে খুটখুট শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আলম ভাইয়ের। আলম ভাই আমার বড় ফুফুর ছেলে। ঘরের মধ্যে কে যেন টর্চলাইট জ্বালিয়ে হাঁটাহাঁটি করছে খুব সাবধানে। মনে হয়, কিছু খুঁজছে। ঘুমঘুম চোখেই আলম ভাই জিজ্ঞাসা করল, ‘কে? সেজ মামা?’
অপর পাশ থেকে উত্তর এলো, ‘হুম’।
আলম ভাই নিশ্চিন্ত মনে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন।
ভোরে দাদির চিৎকারে ঘুম ভেঙে গেল সবার। ফজরের নামাজের জন্য অজু করতে বের হয়েছিলেন দাদি। দরজা খুলতেই সামনে খোঁড়া গভীর গর্তে পড়ে গেছেন। গর্তটা বাইরে থেকে ঘরের দাওয়ার নিচ দিয়ে কেটে ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমাদের বাড়িতে দুটি কাঠের দোতলা ঘর। একটি ঘরে আমরা থাকি, এটা ছোট ঘর। আরেকটি ঘর, যেটাকে বড় ঘর বলা হয়, সেটিতে দাদি এবং অন্যরা থাকেন।
সে সময় আমাদের বাড়িতে প্রায়ই অনেক আত্মীয়স্বজন আসতেন। সবাই মিলে জমজমাট হয়ে থাকত বাড়িটা। আমাদের বেশ ভালো লাগত। সেবার ছোট ফুফু–ফুফা তাঁদের ছেলে শুভকে নিয়ে এলেন। বড় ফুফুর ছেলে আলম ভাই এবং আরও কেউ কেউ ছিলেন। ছোট ফুফুদের কাপড়চোপড়, গয়নাগাটি গোছানো ছিল বড় একটি লাগেজে।
সকালবেলায় আম্মা এসে আমাকে ডেকে তুললেন ঘুম থেকে। বললেন, ফুফুদের সবকিছু চুরি হয়ে গেছে।
আমি লাফ দিয়ে উঠে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘শুভ ভাইয়াকেও কি নিয়ে গেছে?’ শুভ ছোট ফুফুর ছেলে, আমার চেয়ে কিছুটা ছোট।
আমার প্রশ্ন শুনে এমন পরিস্থিতির মধ্যেও আম্মা হেসে দিলেন। বাইরে গিয়ে দেখি, আমাদের বিশাল উঠানের পুরোটাই মানুষ আর মানুষ। আমি ঘরের পেছনে গিয়ে দেখলাম, দাওয়ার নিচ দিয়ে বাইরে থেকে ঘরের ভেতর পর্যন্ত বিশাল সিঁধ বা গর্ত খোঁড়া। আমাদের ঘরগুলো তখন ছিল মাটির। তাই মাটির দাওয়ার নিচ দিয়ে সহজেই সিঁধ কাটা গেছে।
ছোট ফুফুর জিনিসপত্র চুরি হয়েছে বেশি। ফুফুর শ্বশুরবাড়িতে এ নিয়ে আবার কোনো সমস্যা তৈরি হয় কি না, আব্বা–চাচারা এ নিয়ে ভাবছিলেন।
এরপর শুরু হলো চোর খোঁজার মিশন। অনেক খোঁজাখুঁজির পরে তাদের খোঁজ পাওয়া গেল। আমাদের গ্রাম থেকে বেশ দূরে একটি গ্রাম ছিল। নামটা এখন আর বলছি না, তবে সেখানকার মানুষের পেশাই ছিল চুরি করা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, চুরি যাওয়া জিনিসগুলো কীভাবে উদ্ধার করা যায়। কীভাবে সেই অসাধ্য সাধন করেছিলেন আব্বা–চাচারা, সেটি আর মনে নেই এখন। তবে চোরদের সরদারকে একদিন দাওয়াত দেওয়া হলো আমাদের বাড়িতে। তাঁদের জন্য ভালো খাওয়াদাওয়ার আয়োজন করা হলো। সরদার তাঁর সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে বীরবিক্রমে এলেন দাওয়াত খেতে। তাঁর গায়ে একটি দামি শাল জড়ানো। অবাক করার বিষয়, সেটি ছিল আমার দাদির। মেজ কাকা শালটা নিয়ে এসেছিলেন কাতার থেকে। আমাদের বাড়ি থেকে চুরি করা শাল গায়ে দিয়ে তাঁরা এসেছেন আমাদেরই বাড়িতে দাওয়াত খেতে!
যাহোক খাওয়াদাওয়া শেষে চলে গেলেন তাঁরা। দু–এক দিন পরে বাড়ির পাশের খলা থেকে উদ্ধার করা হলো চুরি যাওয়া বেশির ভাগ জিনিস।
আমাদের সেই মাটির বাড়িটি এখন বদলে গেছে। এখন আর নিয়মিত গ্রামেও যাওয়া হয় না। হয়তো বছরে একবার-দুবার যাওয়া হয়। তবে বাড়ি গেলে শৈশবের ঘটনাটি মনে পড়ে। কেমন আছেন সেই গ্রামের মানুষ, খোঁজ নেওয়া হয়নি কখনো।