প্রাণে ধরি মাতৃভাষা

শুভাশিস সিনহা

মাতৃভাষা যখন নাগরিকদের রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত হয়, তখন রাষ্ট্রভাষার দাবি ওঠে। রাষ্ট্রের আপামর মানুষ মাতৃভাষাকে প্রাণকেন্দ্রে রেখে তাদের রাজনৈতিক পরিচয়, নাগরিক অধিকার ও অভিপ্রায়ের নিশানা খুঁজতে থাকে। ১৯৫০–এর দশকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণও তা–ই করেছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকবর্গের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে নিজেদের ঐক্যকে চিনেছিল ভাষার মধ্য দিয়ে, ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভাষাগত জাতীয়তার রূপ তারা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহীদের রক্তের মধ্য দিয়ে যে নতুন ইতিহাসের উত্থান ঘটে, সেই ইতিহাসের প্রবহমানতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ নামের একটি রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। ভাষাগত পরিচয়ের ঐক্যসূত্রে একটি দেশের প্রতিষ্ঠা পৃথিবীতে বিরল। অন্য সব জাতীয়তাবাদী প্রকল্পের চেয়ে এর তাৎপর্য মৌলিক বৈকি।

আমি মণিপুরি জনগোষ্ঠীর সদস্য। বাংলা আমার মাতৃভাষা নয়। তবু জ্ঞান, বুদ্ধি আর নান্দনিকতার চর্চা শুরুর সময়টা থেকে—সেই কৈশোরকালেই আমার মাতৃভাষার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরির পাশাপাশি বাংলাও মাতৃভাষাতুল্য হয়ে ওঠে। স্কুল–কলেজে পড়ার অনিবার্যতার জন্যই শুধু নয়, এই ভূখণ্ডের সব জনসমাজের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে এবং শিল্পসাহিত্যের প্রায় সব রসদ এ ভাষার মধ্য দিয়ে গ্রহণ করার কারণেও বাংলার সঙ্গে আমার এ রকমই সম্পর্ক। শিল্পসাহিত্যের একজন কর্মী হিসেবে দ্বিভাষিক এক চেতনাজগতের অংশী হওয়ার মধ্যে চমৎকারিতা আছে, আছে রোমাঞ্চও। সেই জায়গা থেকে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মহত্ত্ব অনুভব করি।

কিন্তু রাজনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির লড়াইয়ে জনগণের যে উপাদান একটি ঐক্যপ্রতীক সূচিত করেছিল, ভুলে গেলে চলবে না সেই ভাষা এই রাষ্ট্রের বেশ কিছু জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা নয়। একুশের চেতনা তাহলে তাদের মধ্যে কীভাবে কাজ করে বা করবে? এ নিয়ে ভাবতে গেলেই আমরা উপলব্ধি করব, যেকোনো জাতীয়তাবাদই আসলে রাজনৈতিক সংগ্রামের একটি উপাদান মাত্র। কোনো ভূখণ্ডের বৃহত্তর জনমানসের মুক্তির স্বার্থেই তার প্রকাশ। সংগ্রাম শেষে তাকে বিকশিত ও অভিযোজিত হতে হবে রাষ্ট্রের সব জনগণের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে। কল্যাণমূলক রাষ্ট্রে তা-ই হয়ে ওঠে। সেই আকাঙ্ক্ষা বা চেতনা তখন রাষ্ট্রের মূল ভাষাটির সঙ্গে অপরাপর সব ভাষার, এমনকি মাত্র একজন মানুষের টিকে থাকা মাতৃভাষাটিরও পরিচয় ও মর্যাদা রক্ষার জন্য তৎপর থাকবে। স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে এই জায়গাটিতে কতটুকু কাজ হয়েছে তা প্রশ্নসাপেক্ষ। অথচ যে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সব বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্তির লড়াইয়ে এ ভূখণ্ডের মানুষের আপ্তমন্ত্র ছিল ভাষা; সেই রাষ্ট্র যদি তার আর সব ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের পথে সহযোগী ও সহমর্মী হতে না পারে, তাহলে বৃহত্তর সেই চেতনার ক্ষয় ঘটে।

আমার যে মাতৃভাষা—বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, তারও রয়েছে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ইতিহাস, যে ইতিহাসের স্রোতে ভেসে ওঠা রক্তপদ্ম শহিদ সুদেষ্ণা সিংহ। ফলে সালাম বরকত রফিক জব্বারের বৃহত্তর একুশের চেতনা একজন সুদেষ্ণার ভাষাগত চেতনাকেও ধারণ করে।

একুশের রক্তিমাভ ভোর আমার কাছে মাতৃভাষাকে প্রতিবার নতুন করে ভালোবাসার এবং প্রাণে ধারণ করার মাহেন্দ্রক্ষণ।

লেখক: মণিপুরি কবি ও নাট্যকার