এক সাংবাদিক ছবি তুলছিলেন। হঠাৎই আরেক ব্যক্তির আগমন। সাংবাদিকের মুখ টেপ লাগিয়ে বন্ধ করে দিলেন তিনি। এরপর শিকল পেঁচিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে তালা লাগিয়ে দিলেন সাংবাদিকের গায়ে। তাঁর গলায় ঝুলিয়ে দেওয়া হলো ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ লেখা বোর্ড—দেশের গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হওয়ার বিষয়টি প্রতীকী চিত্র ‘পারফরম্যান্স আর্ট’–এর মধ্য দিয়ে তুলে ধরা হলো মঞ্চে।
শুক্রবার বিকেলে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে আয়োজিত সাংস্কৃতিক সমাবেশের মঞ্চে গণমাধ্যমের বর্তমান বাস্তবতাকে প্রতীকী চিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেন সংগীতশিল্পী অমল আকাশ।
‘ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার দাবিতে’ এই সাংস্কৃতিক সমাবেশের মঞ্চের আয়োজক ‘লেখক–শিল্পী–শিক্ষক–সাংবাদিক’। সমাবেশে ছিল প্রতিবাদী গান, পথনাটক, মূকাভিনয়, পারফরম্যান্স আর্ট, কবিতা পাঠ ও মুক্ত ক্যানভাসে প্রতিবাদী চিত্রকর্ম অঙ্কন। এসব আয়োজনের মধ্য দিয়ে ভোটাধিকার ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরেন শিল্পীরা।
আয়োজনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে সূচনা বক্তব্যে কবি সাখাওয়াত টিপু বলেন, একতরফা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে দেশে অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে। নানাভাবে মানুষের অধিকার এখন ভূলুণ্ঠিত। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই। আরেকটি একতরফা নির্বাচনের পাঁয়তারা চলছে। গণতন্ত্র ও মৌলিক অধিকার না থাকলে একদিন লিবিয়া, ইরাকের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
সমাবেশে পরিবেশনা শুরু হয় শিল্পী অমল আকাশের পারফরম্যান্স আর্টের মধ্য দিয়ে। এর শেষ দৃশ্যটি ছিল—এক সাংবাদিকের গলায় ঝোলানো ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ লেখা বোর্ড আগুনে পুড়িয়ে ফেলে হচ্ছে।
এরপর মঞ্চে সংগীত পরিবেশন করে গানের দল প্যারাফিন। কবিতা পড়ে শোনান ফেরদৌস আরা রুমি ও কায়েস মাহমুদ। উন্নয়নের বঞ্চনা নিয়ে একটি ঘোড়ার ডিম ও তার স্বদেশ ভাবনা নামের নাটক পরিবেশন করে নাটকের দল এই বাংলায়। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিয়ে এই নাটকের সংলাপ ‘উন্নয়নের ড্রেন দিয়ে নামতে পারছে না বৃষ্টির পানি’ দর্শকদের মধ্যে হাস্যরসের সৃষ্টির করে।
নাটকের দল থিয়েটার ৫২ পরিবেশন করে নাটক একটি সাহসী ফুল দেখা যায়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ব্যাংক লুট, অর্থ পাচার, ভোটাধিকার হরণের মতো নানা বিষয় উঠে আসে নাটকটিতে।
এই নাটকের পর গান শোনান এলাহী মাসুদ। পরে ছিল শ্রুতি সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর মূকাভিনয় উন্নয়নের সন্দেশ ও এক ক্ষুধার্তের গল্প। বিদেশি দাতা সংস্থার ঋণ, সরকারি দলের নেতাদের সম্পদ ফুলেফেঁপে ওঠা আর দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দুর্দশার চিত্র মূকাভিনয়ে উঠে আসে।
সমাবেশ মঞ্চের ডান পাশে ছিল প্রতিবাদী রাজনৈতিক কার্টুনের প্রদর্শনী। সমাবেশের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিনের জনতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে মঞ্চের পাশে ছবি আঁকেন শিল্পীরা। এ ছাড়া সমাবেশ মঞ্চে বিভিন্ন সময় গান শোনান সায়ান, রোমান, আনা নাসরিন ও সোহাগ রহমান। আর কবিতা পাঠ করেন হাসান জামিল, সৈকত আমীন, শোয়েব মাহমুদ, ইকবাল আহমেদ, আমীর খসরু। এ ছাড়া ডেভেলপমেন্ট নামের একটি নাটক পরিবেশন করে নাটকের দল তীরন্দাজ। আরও ছিল সুমনা আকতারের পারফরম্যান্স আর্ট, এতে অনিয়মের বিরুদ্ধে মানুষকে সোচ্চার হতে আহ্বান জানানো হয়।
সন্ধ্যা পৌনে সাতটার দিকে মঞ্চ থেকে জানানো হয়, প্রশাসন সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করতে চাপ দিচ্ছে। যে কারণে সবার নির্ধারিত পরিবেশনা শেষ করা সম্ভব না–ও হতে পারে। এরপর আয়োজকেরা সমাবেশ কিছুটা সংক্ষিপ্ত করেন। তালিকায় থাকা কয়েকটি পরিবেশনা বাদ দেওয়া হয়। সমাবেশ শেষ হয় সমগীত সাংস্কৃতিক প্রাঙ্গণের গানের মধ্য দিয়ে।
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ শুক্রবার রাতে প্রথম আলোকে বলেন, আয়োজকেরা যা বলেছেন, সেটি ঠিক নয়। সেখানে নিরাপত্তা নিয়ে কোনো শঙ্কা ছিল না। পুলিশ আয়োজকদের এমন কিছু বলেওনি।
তবে আয়োজকদের একজন অমল আকাশ প্রথম আলোকে বলেন, সমাবেশ চলার সময় সন্ধ্যার একটু আগে পুলিশের এক সদস্য এসে তাঁদের বলছেন নিরাপত্তার শঙ্কা রয়েছে। সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে সমাবেশ শেষ করতে অনুরোধ করেন তিনি। যে কারণে কিছুটা বাধ্য হয়ে সমাবেশ সংক্ষিপ্ত করতে হয়। পুলিশের এ ধরনের অনুরোধ থেকে বোঝা যায়, প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক সমাবেশ হোক, সেটি তারা চায় না।