সীমাহীন বাধা পেরোনো এই মায়ের মুখে এখন ভুবন জয়ের হাসি

সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত দুই ছেলে রেফাত ও রেহানের সঙ্গে মা রেহেনা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

যমজ রেফাত আর রেহানের বয়স এখন ২৬ বছর। এক বছর তিন মাস বয়সে চিকিৎসক জানিয়েছিলেন, রেফাত আর রেহানের সেরিব্রাল পালসি (সিপি) এবং স্বল্পমাত্রায় অটিজম আছে। দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে, ওয়াকার আর হুইলচেয়ারে বসিয়ে, সিঁড়ির রেলিং ধরে হাঁটিয়ে পড়াশোনা করিয়েছেন তাঁদের মা রেহেনা আক্তার। বড় ছেলে রেফাত জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন টাঙ্গাইলের হাজী আবুল হোসেন ইনস্টিটিউট অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং পরীক্ষা দিয়েছেন। ছোট ছেলে রেহান মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক শেষ করেছেন। রেহেনা আক্তার এখন স্বপ্ন দেখছেন, ছেলেদের পিএইচডি করাবেন।

হাত–পায়ে শক্তি নেই, তারপরও দুই ছেলে এখন নিজেরাই তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারেন। রেলিং ধরে সিঁড়ি ওঠানামা করা, লিফটে চড়া—সবই করতে পারেন। খাওয়াসহ নিজেদের কাজ করতে পারেন। এই ছেলেদের বাসায় রেখে রেহেনা আক্তার নিজের চিকিৎসার জন্য ভারতের চেন্নাই যেতেও এখন আর ভয় পান না। ভরসা জন্মেছে, ছেলেরা ঠিকই নিজেদের সামলে নিতে পারবেন। ছোটবেলা থেকে ছেলেদের সেভাবেই সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন।

তবে ছেলেদের পিএইচডি করাবেন—এ স্বপ্ন দেখতে কত ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে, তা শুধু জানেন রেহেনা আক্তার। তাই তো তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন, ‘স্বপ্ন তো অনেক। কিন্তু পদে পদে জীবন তো থেমে যায়। চলতে চলতে হোঁচট খেতে খেতে কখনো কখনো খেই হারিয়ে ফেলে ভাবতে হয়...।’ রেহেনা আক্তার বলেন, ‘তবু হাঁটতে শুরু করি, হেঁটে চলেছি যুদ্ধ জয়ের আশায়।’

যুদ্ধ জয়ের নেশায় পেয়ে বসেছে রেহেনা আক্তারকে। সন্তানদের জন্য নিজের জীবন থেকে চাকরি, সুখ–স্বাচ্ছন্দ্য, সব বাদ দিয়েছেন। তবে এ পর্যায়ে এসে এই মা বলার সাহস পাচ্ছেন, ‘এখন মনে হয়, আমি না থাকলেও আমার ছেলেরা নিজেদের জীবন চালিয়ে নিতে পারবে। এমনকি গাড়িতে করে ছেলেরা নবম শ্রেণিতে পড়ুয়া বোনকেও কোচিংয়ে নিয়ে যেতে পারে, বোনকে দেখে রাখতে পারে।’

জন্মগত ত্রুটি নিয়ে পৃথিবীতে আসা যমজ ভাই রেফাত ও রেহান সব বাধা অতিক্রম করে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী
ছবি: সংগৃহীত

টাঙ্গাইলে থাকেন রেহেনা আক্তার। মুঠোফোনে কথা হলো এ মায়ের সঙ্গে। ছেলেদের এ বয়স পর্যন্ত বড় করতে রেহানা শুনেছেন অনেক কটু কথা। বললেন, এই জীবনে ছেলেদের নিয়ে তিনি যে শারীরিক কষ্ট করেছেন, সেই কষ্টের চেয়েও মানুষের কাছ থেকে শোনা বাজে মন্তব্য বেশি পীড়া দিয়েছে। তবে একসময় তিনি প্রতিবাদ করা শিখে গিয়েছিলেন। তাই তো বলেন, ‘যেকোনো ধরনের প্রতিবন্ধী সন্তানের মা–বাবাকে আগুন হতে হবে। সন্তান নিয়ে কেউ বাজে কথা বলতে গেলেই বাবা ও মায়ের মধ্যে যে আগুন, তাতে পুড়ে শেষ হয়ে যাবে বাজে মন্তব্য করতে আসা ব্যক্তি। এ ছাড়া এই ধরনের সন্তান নিয়ে এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকার উপায় নেই।’

রেহেনা আক্তার আরও বলেন, তিনি ছেলেদের নিয়ে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন ১৯৯৬ সালে। বর্তমানে যে মা–বাবার এই ধরনের সন্তান আছে, তাঁদের সংগ্রামটাকে একটু সহজ করার জন্য ‘একজন মা এবং দুইটি হুইলচেয়ার’ নামে ইউটিউব ভিডিওতে তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতা ধারাবাহিকভাবে বর্ণনা করেছেন।

দুই হাত, দুই পায়ে সমস্যা থাকলেও এখন নিজেরাই সিঁড়ি ভেঙে চলতে পারেন রেফাত-রেহানরা
ছবি: সংগৃহীত

এইটুকু পথ অতিক্রম করতে রেহেনা আক্তার সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছেন স্বামী ইঞ্জিনিয়ার মো. আনোয়ার হোসেনের কাছ থেকে। তাই বারবার কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলেন। বললেন, সন্তানদের জন্য তাঁরা স্বামী-স্ত্রী কাজ ভাগ করে নিয়েছিলেন বা সমঝোতা করেছিলেন—ছেলেদের চিকিৎসার জন্যই অর্থের প্রয়োজন। সেই অর্থ উপার্জন করবেন স্বামী। আর দুই ছেলের থেরাপি, প্রশিক্ষণ, পড়াশোনা করানো—সবদিক সামলাবেন রেহেনা আক্তার। সেভাবেই চলছে। আনোয়ার হোসেন পেশাগত দায়িত্ব শেষে স্ত্রী ও সন্তানদের সময় দেন। এভাবেই এ দম্পতি বিবাহিত জীবনের ৩১টি বছর পার করেছেন। মা–বাবার বিবাহবার্ষিকীতে তাঁদের চমকে দিতে উপহার দিয়েছেন রাফি হোসেন রেফাত, আহসানুল হোসেন রেহান ও মেয়ে আদিবা হোসাইন।

দুই ছেলেকে নিয়ে সংগ্রামটা কেমন ছিল, তা জানতে চাইলে রেহেনা আক্তার বলেন, ‘ছেলেদের এক বছর দু–তিন মাসের মাথায় সেরিব্রাল পালসি শুনে বুকটা ধুঁক করে উঠেছিল। হাল ছাড়িনি। যে যা বলেছে, তা–ই করেছি। কবিরাজি, অ্যালোপ্যাথি—কিছুই বাদ দিইনি। টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা, কুমিল্লা, সাভার হয়ে আবার টাঙ্গাইলে থিতু হয়েছি। একটা সময় দুই ছেলেকে কোলে নিয়ে থেরাপি দিতে নিয়ে যাওয়া, বাসায় ফিরে ঘরের কাজ—এর মধ্যেই জীবনটা আটকে গিয়েছিল।’

এই হুইলচেয়ার নিয়ে চলাচলের বাধা পেরিয়েছেন তাঁরা
ছবি: সংগৃহীত

রেহেনা আক্তার জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পরও রেহানকে ভর্তি করাতে পারেননি। টাঙ্গাইলে এক ছেলে আর ঢাকায় আরেক ছেলেকে রাখা সম্ভব ছিল না। কণ্ঠে যুদ্ধ জয়ের হাসি নিয়ে তিনি বলেন, সাভারের সিআরপির চিকিৎসকেরা তাঁকে মডেল মা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। একইভাবে ছেলেদের স্কুল-কলেজ থেকেও ‘বেস্ট মাদার’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। ইংল্যান্ডের একটি পত্রিকায় এই মা ও ছেলেদের গল্প ছাপা হয়েছিল বহু বছর আগে।

রেহেনা আক্তার ইউটিউবের ভিডিওতে বলেছেন, বাসা ভাড়া একটু কমে পাবেন বলে পাঁচতলা, তিনতলায় বাসা ভাড়া নিয়েছেন। দুই ছেলেকে কোলে করে সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা করতে হয়েছে। কতবার পড়ে গিয়ে তিনি ও ছেলেরা ব্যথা পেয়েছেন, তার ঠিক নেই। রেহেনা আক্তার বা তাঁর স্বামী খরচ কমাতে প্রয়োজনের চেয়েও কম জিনিস দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। একবার ঘরের কিছু আসবাব বানিয়েছিলেন, তা–ই দেখে এক প্রতিবেশী নারী বলেছিলেন, ছেলেদের এই অবস্থা, আর আপনারা ঘরের আসবাব কিনেছেন?

স্বামী, দুই ছেলে ও মেয়ের সঙ্গে রেহেনা আক্তার
ছবি: সংগৃহীত

রেহেনা আক্তার বলেন, নিজের বা স্বামীর পরিবারের সদস্যরা এই দুই ছেলেকে নিয়ে কখনো বাজে মন্তব্য করেননি। তবে অনেক আত্মীয় এবং আশপাশের পরিচিত-অপরিচিত মানুষ দুই ছেলেকে নিয়ে বের হলেই হয় বিরক্ত হতেন, না হয় বাজে মন্তব্য করতেন। মানুষের ছিল হাজারো প্রশ্ন, আক্ষেপ। ‘দুইটা পোলা আঁতুড়, আহা!’, ‘ছেলেরা বোবা-ল্যাংড়া নাকি?’, ‘ছেলেদের বাবা-মা না জানি কত পাপ করেছেন, তাই দুইটা ছেলেই এমন হয়েছে’—এমন নানা কটু কথা শুনতে হয়েছে তাঁদের।

রেহেনা আক্তার আরও বলেন, ‘সন্তানের শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে জয় করতে কতটা সংগ্রাম করতে হয় বা হয়েছে, তা কেউ বুঝতে চাইত না। প্রশ্নবাণে মাঝেমধ্যে মনে হতো, আমি আর আমার দুই ছেলে আসামি, আর আশপাশের সবাই উকিল। স্কুলের এক শিক্ষক মা হওয়ার পর বলেছিলেন, তিনি যখন অন্তঃসত্ত্বা হন, তখন সময়ের আগেই ছুটি নিয়েছিলেন, যাতে এই দুই ছেলেকে চোখের সামনে দেখতে না হয়। ভয় ছিল, এদের দেখলে যদি ওই শিক্ষকের সন্তানও এমন হয়। গৃহকর্মীরাও ছেলেদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করত। ব্যথা দিত।’

রেহেনা আক্তার জানান, স্কুলে ছেলেরা একা বসতে পারতেন না বলে শিক্ষকের অনুমতি নিয়ে তিনি দুই ছেলের মাঝখানে বসে ক্লাস করাতেন। স্কুলভ্যানে ছেলেদের সঙ্গে যাতায়াত করতেন। আস্তে আস্তে ছেলেরা যখন বসা শিখে যান, তখন তিনি স্কুলের দরজার কাছে এবং একসময় মাঠে বসে থাকতেন। আর এখন ছেলেরা একাই বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া–আসা করা শিখে গেছেন।

রেহানা আক্তারের কণ্ঠে আবার খুশির আমেজ পাওয়া যায়। বেশ গর্ব করেই বলেন, ছেলেরা ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনায় খুব ভালো। এ কারণে শিক্ষকদের নজরে পড়তেন সহজেই। আর ছেলেদের ছোটবেলা থেকেই বাইরে বেড়াতে নিয়ে যেতেন রেহানা আক্তার। বিকেলে চা বা কফি খেতে ইচ্ছা করলে ছেলেদের নিয়েই বের হন। নদীর পাড় বা সমুদ্রে বেড়াতে যান পরিবারের সদস্যরা। ছেলেরা তাঁদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। রেহানা আক্তার ছেলেদের ছোট ছোট সাফল্য ভিডিও করে তা ফেসবুকে শেয়ার করেন। দুই ছেলেকে নিয়ে রেহানা আক্তার আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি অন্য মা-বাবাকেও সাহস দিচ্ছে।