‘এটা নাই, ওইটা নাই বলে টাকা নেন কর্মকর্তারা’

জাতীয় সংসদ ভবন
ফাইল ছবি

ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে ভূমি জরিপ ও মৌজার মূল্য নির্ধারণে অনিয়ম নিয়ে জাতীয় সংসদে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলের একাধিক সংসদ সদস্য। আজ রোববার জাতীয় সংসদে ভূমি উন্নয়ন কর বিল পাসের আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ সদস্যরা ভূমিসংক্রান্ত সেবা পেতে মানুষের হয়রানির কথা তুলে ধরেন।

বিলের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, ‘ভূমি জরিপ পুরোনো নিয়মে চলছে। জরিপ মানুষকে ফকির বানিয়ে দেয়। যেখানে জরিপ, সেখানেই মানুষ গরিব হচ্ছে। সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়ছয় করে, কাগজ নাই, এটা নাই, ওইটা নাই বলে টাকা নেন ভূমির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সাধারণ মানুষ কোনো প্রতিকার পান না।’

মানুষ হয়রানির শিকার হচ্ছেন জানিয়ে রুস্তম আলী ফরাজী অভিযোগ করেন, ৯০ শতাংশ জরিপকারী দুর্নীতিবাজ। জরিপকারীরা প্রবাসীদের পরিবারের ওপর জুলুম বেশি করেন। তহসিলদারদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা খারাপ। জরিপে দুর্নীতি বন্ধে মন্ত্রীকে উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

জাতীয় পার্টির আরেক সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, সাবরেজিস্ট্রারেরা নিজেদের ইচ্ছামতো জমির মৌজার মূল্য বসিয়ে দেন। ভূমিমন্ত্রী যদি এসি ল্যান্ড, সার্ভেয়ার, কানুনগো, সাবরেজিস্ট্রারদের সঙ্গে নিয়ে বসেন তাহলে দেখা যাবে, সবচেয়ে কম রেটের মৌজায় বেশি দাম দেখানো হয়েছে।

বাংলাদেশের যেসব খাতে দুর্নীতি হয়, তার মধ্যে ভূমি অন্যতম বলে উল্লেখ করেন গণফোরামের সংসদ সদস্য মোকাব্বির খান। তিনি বলেন, সিভিল (দেওয়ানি) মামলার কয়েক লাখই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিসংক্রান্ত। ২০ থেকে ৩০ বছর মামলার পেছনে ব্যয় করেও মানুষ কোনো রায় পাচ্ছেন না। অনেক মানুষ জীবদ্দশায় মামলার রায় দেখে যেতে পারেন না। অনেক মানুষ নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। এ জন্য দায়ী ভূমির অসাধু কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। ভূমির কোনো সেবা ঘুষ দেওয়া ছাড়া পাওয়া যায় না। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

সাধারণ মানুষের কাছ থেকে নয়ছয় করে, কাগজ নাই, এটা নাই, ওইটা নাই বলে টাকা নেন কর্মকর্তারা।
রুস্তম আলী ফরাজী, সংসদ সদস্য, জাতীয় পার্টি

ভূমি জরিপ স্বচ্ছ করার দাবি জানান জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ। তিনি বলেন, ‘আমি দেখেছি, আমার জমি, আমার নামে কাগজ, খাজনার রসিদ আছে; কিন্তু যাঁর দখল আছে, তাঁর নামে পরচা দিয়ে দিয়েছে। আমাকে বলছে, “৩০ ধারা করেন, ৩২ ধারা করেন।” বেশির ভাগ ঘটনাই এ রকম।’

বিরোধী সংসদ সদস্যদের সমালোচনার জবাবে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী বলেন, সাধারণ মানুষকে এসব হয়রানির থেকে রেহাই দিতে বিভিন্ন সংস্কার কার্যক্রম নেওয়া হয়েছে। অনলাইনে রাজস্ব আদায়ের কাজ শুরু হওয়ায় অনেক হয়রানি কমেছে। তিনি বলেন, বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা যেসব বিষয়ে কথা বলেছেন, সেগুলো ভূমি কর উন্নয়ন বিল-সম্পর্কিত নয়। সোমবার (আজ) ভূমির আরও বিল সংসদে তোলা হবে, তখন এসব বিষয়ে কথা বলার অনুরোধ জানান তিনি।

পরে বিরোধী দলের সদস্যদের সংশোধনী প্রস্তাবগুলো নিষ্পত্তি শেষে ভূমি উন্নয়ন কর বিল কণ্ঠভোটে পাস হয়। ১৯৭৬ সালের ল্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ট্যাক্স অর্ডিন্যান্স রহিত করে নতুন এ আইন করা হচ্ছে।

ভূমির কোনো সেবা ঘুষ দেওয়া ছাড়া পাওয়া যায় না। সাবরেজিস্ট্রি অফিসে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকা অবৈধ লেনদেন হচ্ছে।
মোকাব্বির খান, সংসদ সদস্য, গণফোরাম

বিলে বলা হয়েছে, ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হবে জুলাই-জুন অর্থবছরে। এখন বাংলা সন (বৈশাখ-চৈত্র) হিসাবে ভূমি উন্নয়ন কর আদায় করা হয়। নতুন বিলে বলা হয়েছে, ভূমি উন্নয়ন কর আদায় হবে জুলাই-জুন অর্থবছরের হিসাবে। প্রতিবছর জুলাইয়ের ১ তারিখ থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে ভূমি উন্নয়ন কর জরিমানা ছাড়া দেওয়া যাবে। তবে খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবান—এই তিন পার্বত্য জেলায় এই আইন কার্যকর হবে না।

বিলে বলা হয়, কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল ব্যক্তি বা পরিবারভিত্তিক কৃষিজমির মোট পরিমাণ ৮ দশমিক ২৫ একর বা ২৫ বিঘা পর্যন্ত হলে ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে না। তবে এসব জমির পরিমাণ ২৫ বিঘার বেশি হলে সম্পূর্ণ কৃষিভূমির ওপর ভূমি উন্নয়ন কর দিতে হবে।

বিলে বলা হয়েছে, আখ ও লবণ চাষের ভূমি এবং কৃষকের পুকুরও (বাণিজ্যিক মৎস্য চাষ ব্যতীত) মওকুফের আওতায় থাকবে। এ ছাড়া কৃষিভূমি পল্লি এলাকা বা পৌর এলাকা যেকোনো স্থানে অবস্থিত হোক, সব ক্ষেত্রে অভিন্ন ভূমি উন্নয়ন কর হার ও শর্ত প্রযোজ্য হবে। সরকার যেকোনো ব্যক্তি বা শ্রেণির ব্যক্তিবর্গ বা সংস্থার উন্নয়ন কর মওকুফ করতে পারবে।

বিলে বলা হয়েছে, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা প্রতিবছর জুলাইয়ের মধ্যে এলাকা পরিদর্শন করে ভূমির ব্যবহারভিত্তিক অবস্থা বিবেচনায় নির্ধারিত ফরমে সব মৌজার ভূমি উন্নয়ন কর নির্ধারণ করে তা সহকারী কমিশনারের (ভূমি) কাছে পাঠাবেন।