ব্যয় কমিয়ে টিকে থাকার চেষ্টা

দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় নিম্নবিত্ত পরিবারে মাছ–মাংস কেনা কমেছে আগেই। এবার অন্যান্য খাতে ব্যয় কমানোর চেষ্টা।

‘খাওয়ার সময় সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে কষ্ট লাগে’—বলছিলেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের রংপুর কার্যালয়ের কর্মকর্তা আবু আজাদ রহমান। তাঁর এ কষ্ট লাগার কারণ দুই সন্তানের পাতে তাদের পছন্দের খাবার তুলে দিতে না পারা।

আবু আজাদ রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম এতটা বেড়েছে যে সংসারের ব্যয় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তাই এখন মাছ ও মাংস কেনা কমিয়ে দিয়েছেন। ভাজি, ভর্তা, ডাল দিয়ে দুপুর ও রাতের খাবার খেতে হয়। আগে প্রতিদিন সকালে দুই সন্তানের জন্য নিয়ম করে দুটি ডিম রাখতেন। এখন সপ্তাহে তিন দিনের বেশি ডিম খেতে দিতে পারছেন না।

দেশজুড়ে দ্রব্যমূল্য বেড়েছে, জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে। বাড়তি খরচ সামাল দিতে আবু আজাদ রহমানের মতো সীমিত আয়ের মানুষের অনেকেই এখন নানা খাতে ব্যয় কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। মাছ, মাংস ও দুধ কেনা বাবদ ব্যয় কমানো হচ্ছে। কেউ কেউ স্বল্প দূরত্বের পথে রিকশার বদলে হেঁটে চলাচল শুরু করেছেন। পরিবার নিয়ে বাইরে খাওয়া, ঘুরতে যাওয়া, বিকেলে হালকা খাবার খাওয়া—এসব বাদ দিতে হয়েছে।

এত কিছুর পরও যাঁরা সংসারের খরচ সামলাতে পারছেন না, তাঁরা সন্তানদের শিক্ষার পেছনে ব্যয় কমানো, একেবারেই অসহ্য পর্যায়ে না গেলে রোগ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে না যাওয়া, দুপুরে বাইরে রুটি-কলা খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া অথবা পরিবারকে গ্রামে পাঠিয়ে মেসে ওঠার মতো পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছেন।

জীবনযাত্রার ব্যয়ের পরিস্থিতি কী, তা জানতে গত তিন দিনে রাজধানীসহ আটটি বিভাগীয় শহর—ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহের ৪০টি সীমিত আয়ের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা। এসব পরিবার জানিয়েছে, গত দুই বছরে তাদের আয় যে হারে বেড়েছে, তার চেয়ে খরচ বেড়েছে অনেক বেশি হারে। সচ্ছলেরা নানাভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছেন। কষ্টে আছেন সেই সব মানুষ, যাঁরা ছোট চাকরিজীবী। তাঁরা বলছেন, তাঁরা চাইলেই নিজেদের বেতন বাড়িয়ে নিতে পারেন না। বাড়তি পরিশ্রম করে বাড়তি আয় করবেন, সেই সুযোগও নেই।

নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিম্নবিত্ত পরিবারে আমিষ কমিয়ে শর্করা গ্রহণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ, আমিষের দাম বেশি। এরপরও সামাল দিতে না পারলে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়।
সেলিম রায়হান, অর্থনীতিবিদ

যেমন দেশের রপ্তানিমুখী পোশাক খাতে সর্বশেষ মজুরি ও কর্মীদের বেতনকাঠামো হয়েছিল ২০১৮ সালে। নিয়ম অনুযায়ী, বছরে ৫ শতাংশ হারে তাঁদের মজুরি বাড়ার কথা। যদিও মজুরি বৃদ্ধির নির্ধারিত হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি।

চট্টগ্রামের হালিশহর এলাকার বাসিন্দা রাজীব মুহুরি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করেন। মাসে তাঁর আয় সাকল্যে ১৩ হাজার টাকা। এ টাকায় চলে তিনজনের সংসার—নিজে, স্ত্রী ও মেয়ে।

রাজীব প্রথম আলোকে বলেন, টাকা বাঁচাতে এখন কিছু পথ হেঁটে, কিছু পথ গণপরিবহনে চড়ে অফিসে যান তিনি। ফেরেনও একই কায়দায়। বাজারের ব্যয় কমিয়েছেন। আগে বাসায় ফেরার সময় মেয়ের জন্য কিছু না কিছু কিনে আনতেন। এখন আর সেটা করেন না।

দেশে এখন নিত্যপণ্যের দামের যে পরিস্থিতি চলছে, তা সাম্প্রতিক কালে দেখা যায়নি। চাল, ডাল, তেল, চিনি, গুঁড়া দুধ, ডিম, মুরগি—মোটামুটি সবকিছুর দামই বাড়তি। বাড়ার হারও অনেক বেশি।

আটার উদাহরণটি দেওয়া যাক। সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) হিসাবে, গত বছর এই সময়ে ঢাকায় খোলা আটার দাম ছিল ২৮ থেকে ৩২ টাকা; এখন তা ৪৮ থেকে ৫০ টাকা কেজি। এক বছরে দাম বেড়েছে ৬৩ শতাংশ।

প্রথম আলোর প্রতিবেদকদের তথ্য বলছে, পণ্যের দামে বিভাগীয় শহরভেদে কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে মূল্যবৃদ্ধির হার মোটামুটি একই। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে গত জুন মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ (৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ)। জুলাইয়ে তা সামান্য কমেছিল। যদিও মূল্যস্ফীতির এ হার নিয়ে অর্থনীতিবিদেরা প্রশ্ন তুলছেন। তাঁরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি আরও বেশি। এদিকে সরকার জ্বালানি তেলের দাম রেকর্ড পরিমাণে বাড়িয়ে দেওয়ায় নিত্যপণ্যের দাম আরেক দফা বাড়ছে।

ঢাকার মালিবাগ বাজারে গত বৃহস্পতিবার কেনাকাটা করতে যাওয়া লাকী আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত সপ্তাহেও ব্রয়লার মুরগি কিনেছিলাম ১৫০ টাকা কেজি। আজকে (বৃহস্পতিবার) সেটা ২০০ টাকা।’

লাকী আক্তারের স্বামী একটি স্কুলের শিক্ষক। বেতন ও শিক্ষার্থী পড়িয়ে মাসে আয় ২২ থেকে ২৩ হাজার টাকা। তাঁদের দুই সন্তান স্কুলে যায়।

লাকী আক্তার জানান, বাসাভাড়া, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির বিল দিতেই স্বামীর আয়ের অর্ধেক চলে যায়। এ কারণে বাসার একটি কক্ষ আরেকজনের কাছে ভাড়া দিয়েছেন। নিজে একটা বুটিক হাউসে পুঁতি গাঁথার কাজ নিয়েছেন। তবু সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। টাকা ছিল না বলে গত ঈদুল আজহায় গ্রামের বাড়িতে যেতে পারেননি।

শিক্ষার ব্যয়ে কাটছাঁট

৪০টি পরিবারের মধ্যে কেউ কেউ বাধ্য হয়ে সন্তানদের প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ করেছেন। কেউ কেউ প্রাইভেট টিউটর বাদ দিয়ে সন্তানকে কম খরচের কোচিংয়ে দিয়েছেন।

রংপুরের খন্দকার আবদুল করিম মিয়া বিএম বেসরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ফখরুল আনাম জানান, সংসারের ব্যয় সামলাতে অনেক খাতে কাটছাঁট করেছেন তিনি। সর্বশেষ দুই সন্তানের পড়াশোনার ব্যয়েও হাত দিতে বাধ্য হয়েছেন। আগে তাঁর সন্তানেরা একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের কাছে পড়ত। এখন স্থানীয় দুজন কলেজছাত্রের কাছে পড়ছে। এতে খরচ কমেছে।

বরিশাল নগরের সাগরদীর বাসিন্দা বেসরকারি চাকরিজীবী নিজাম উদ্দীন ছেলেকে বাসায় প্রাইভেট টিউটর দিয়ে পড়াতেন। চলতি মাস থেকে শিক্ষককে বাদ দিয়ে অর্ধেক ব্যয়ে ছেলেকে কোচিংয়ে দিয়েছেন।

ময়মনসিংহ নগরের নাটকঘর লেন এলাকার বাসিন্দা আবদুল করিম বলছিলেন, তিনি সন্তানকে প্রাইভেট টিউটর দিয়ে পড়ানো আপাতত বাদ দিয়েছেন। তিনি বলেন, আর কোনো উপায় ছিল না।

সন্তানের প্রাইভেট টিউটর বাদ দিয়েছেন খুলনা নগরের পূর্ব বানিয়াখামারের কমিশনার গলির বাসিন্দা মো. মোস্তফা (৫২)। পেশায় রাজমিস্ত্রির সহকারী এই ব্যক্তি বলেন, যেদিন কাজ পান, সেদিন ৫৭০ টাকা আয় হয়। তবে সেই আয়ে এখন আর সংসার চলছে না। দিন দশেক আগে যে চাল ৫৪ টাকা কেজি কিনেছিলেন, তা কিনতে লাগছে ৬০ টাকা।

‘ভীষণ অসহায় লাগে’

নিত্যপণ্যের দামের বর্তমান পরিস্থিতিটি অন্য সময়ের চেয়ে ভিন্ন। বিশ্ববাজার পরিস্থিতি, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া এবং অব্যবস্থাপনার কারণে এখন মোটামুটি সব পণ্যের দামই বাড়তি। বিপরীতে করোনাকালে ক্ষতির মুখে পড়া মানুষের অনেকেই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেননি।

যেমন মাসুদ পারভেজ (৪০) ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। করোনাকালে তিনি চাকরি হারিয়ে নিজ শহর বরিশালে চলে যান। এখন নগরের ফকিরবাড়ি রোডে একটি রকমারি পণ্যের দোকান দিয়েছেন। তাতে যা আয় হয়, তা দিয়ে মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতির মধ্যে সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়ছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘বাচ্চারা প্রোপার ফিডিং (ঠিকমতো খাওয়ানো) থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। একজন বাবা হয়ে এটা করার অধিকার আমার নেই। কিন্তু কী করব, নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।’

মাসুদ পারভেজ বলেন, ‘সংসারের ব্যয় থেকে বাদের তালিকা দীর্ঘ। কিন্তু তাতেও কুলাচ্ছে না। আরও কমাতে হবে, খাত খুঁজছি।’

রাজশাহী নগরের একটি হার্ডওয়্যারের দোকানের কর্মচারী শহিদুল ইসলাম জানান, মাসে বেতন পান আট হাজার টাকা। আর মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে কিছু আয় হয়। তবে তাতে ছয়জনের সংসার চলছে না। তিনি বলেন, মুদিদোকানে ১৪ হাজার টাকা বাকি পড়েছে। ওদিকে বাধ্য হয়ে মালিকের কাছে বেতন বাড়ানোর দাবি করেছেন। মালিক বিদায় করে দিলে কী করবেন, তা এখনো ঠিক করতে পারেননি।

চিকিৎসকের কাছে ‘যেতে পারি না’

মো. নজির (৫৬) সিলেট শহরের মদিনা মার্কেট এলাকায় ফুটপাতে দেশি ফল বিক্রি করেন। মাসে ২৫ হাজার টাকার মতো আয় হয়। তিনি বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও আয় বাড়েনি। কারণ, পণ্য বিক্রি বাড়ছে না। পাঁচজনের সংসারে ঘরভাড়া দিতে হয় ৭ হাজার ৫০০ টাকা।

নজির বলেন, নিজের কোমরে ব্যথা। বড় মেয়ের দাঁতে ব্যথা। অথচ টাকার অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।

চট্টগ্রাম নগরের একটি বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক মহসিন রনির মেয়ের বয়স ১ বছর ৩ মাস। কয়েক দিন ধরে মেয়ের শরীরে অ্যালার্জি দেখা দিয়েছে। কিন্তু চিকিৎসকের কাছে নিতে পারেননি। তিনি বলেন, ২৫ হাজার টাকা বেতনে এখন আর সংসার চালানো যাচ্ছে না। ঋণ করে চলতে হয়। মেয়েকে চিকিৎসকের কাছে নিলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং ওষুধে অনেক খরচ। তিনি উল্লেখ করেন, পরিস্থিতির উন্নতি না হলে মেয়েকে নিয়ে সরকারি হাসপাতালে যাবেন বলে ঠিক করেছেন।

বিপুলসংখ্যক মানুষ ‘ঝুঁকি’তে

ঢাকায় গত ডিসেম্বরে এক অনুষ্ঠানে অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছিলেন, দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ সব সময় গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ঝুঁকিতে থাকা মানুষের অবস্থা এমন, পানিতে সারা শরীর নিমজ্জিত রেখে নাকটা ভাসিয়ে রাখা। ঢেউ এলে ডুবে যায়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সেলিম রায়হান মনে করেন, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ যে ‘ঢেউ’য়ের কথা বলছেন, সেটা এখন চলছে। এতে অনেকে ডুবে যাওয়া বা দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালের আগের সরকারি হিসাবেই দেশে সাড়ে তিন কোটির মতো মানুষ দরিদ্র। আরও চার কোটির মতো মানুষ দরিদ্র হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়লে নিম্নবিত্ত পরিবারে আমিষ কমিয়ে শর্করা গ্রহণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। কারণ, আমিষের দাম বেশি। এরপরও সামাল দিতে না পারলে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়।

সেলিম রায়হান বলেন, সরকারি ফ্যামিলি কার্ডের মতো কর্মসূচি নিলেও তা মূলত দরিদ্র মানুষকেন্দ্রিক। নিম্নবিত্তের একটি অংশ কোনো কর্মসূচির মধ্যেই নেই।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন বিভাগীয় শহরগুলোতে দায়িত্বরত প্রথম আলোর প্রতিবেদকেরা।]