‘দুটি হাত ছাড়াই মানুষের কৌতূহলের জবাব দিতে পেরেছি’

দুই হাত ছাড়াই জীবনে লড়াই করে বিজয়ী হয়েছেন ফাল্গুনী সাহা। বর্তমানে তিনি ব্র্যাকের মানবসম্পদ বিভাগে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরতছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে
দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব বরিশাল বিভাগের পটুয়াখালীর গলাচিপা উপজেলার ৪ নম্বর সদর রোড বটতলা এলাকার বাসিন্দা ফাল্গুনী সাহার জীবনগল্প।

আমি ফাল্গুনী সাহা, আমার জন্ম বরিশালে; বেড়ে ওঠা পটুয়াখালীর গলাচিপায়। ২০০২ সাল, আমার বয়স তখন ছয়। একদিন বিকেলে পাশের বাড়ির ছাদে খেলছিলাম, হাতে ছিল লোহার রড। খেলতে খেলতে অসতর্কতায় হাতের রডটি বিদ্যুতের তারের সঙ্গে লাগে। বিদ্যুতের প্রবাহ শরীরকে প্রবলভাবে ঝাঁকি দেয়, আমি বেহুঁশ হয়ে যাই। একজন পড়শী প্রথম দেখতে পান, আমার হাত দুটি পুড়ে গেছে। আর আগুনের হলকায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ফোসকা পড়ে যায়।

আমাকে দ্রুত পটুয়াখালীর গলাচিপা সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঝলসানো হাত আর শরীর দেখে বরিশালের আরেকটি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পাঠানো হয়। ১০ দিন পেরিয়ে যাওয়ার পর সেখানকার চিকিৎসকেরা উন্নত চিকিৎসার জন্য আমাকে ঢাকায় নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু ঢাকায় না গিয়ে পরিবার আমাকে ভারতে নিয়ে যায়।

কলকাতা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আমাকে ভর্তি করা হয়। চিকিৎসকেরা আমাকে দেখে বলেন, ‘হাত দুটি রক্ষা করা যাবে না। দ্রুত কেটে ফেলতে হবে। আর কোনো বিকল্প নেই। না হলে হাতে শুরু হওয়া পচন শরীরে ছড়িয়ে পড়বে।’

চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী আমার দুটি হাতই কবজি পর্যন্ত কেটে ফেলা হয়। আমার মা-বাবা আর আত্মীয়স্বজনদের সেকি আহাজারি! সবাই মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। আমার ভবিষ্যৎ নিয়ে অনিশ্চয়তার কথাই বলাবলি করছিল। একটি মেয়ে দুই হাত ছাড়া কীভাবে বড় হবে, কীভাবে জীবন যাপন করবে, লেখাপড়াটা করবে কী করে ইত্যাদি। আমি এসবের কিছুই বুঝতাম না। তখন বোঝার মতো বয়সও ছিল না আমার।

এ দুর্ঘটনা আমাকে জীবনের কঠিন এক বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করায়। ঘরের জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখতাম, আমার বয়সী ছেলেমেয়েরা খেলাধুলা করছে। আমি ঘরে বসে আছি। বন্ধুরা লেখাপড়া করছে। আমি পারছি না। এভাবে কয়েক মাস কেটে গেল।

একসময় আমি আমার কবজিবিহীন দুই হাত নিয়েই স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা শুরু করি। প্রথমে কোনো কিছু ধরার চেষ্টা করি। ব্যর্থ হই। কিন্তু হাল ছাড়ি না। কিছুদিন চেষ্টার পর চামচ ধরতে পারলাম। এরপর কলম ধরার চেষ্টা করি, পারলাম। তারপর লিখতে চেষ্টা করলাম। অবশেষে একদিন আমার নাম, বাসার ঠিকানা লিখলাম। ধীরে ধীরে যখন কলম দিয়ে লিখতে সক্ষম হলাম, মা-বাবার সেকি আনন্দ! আমিও ভীষণ খুশি ও আত্মবিশ্বাসী হলাম।

আমার এ অবস্থা দেখে মা–বাবার মনে একটু আশা জাগল যে আমাকে এখন স্কুলে ভর্তি করানো যায়। স্কুলের শিক্ষকেরা আমার লেখা দেখে খুবই আশাবাদী হলেন। আমাকে আর অভিভাবকদের নিশ্চিত করে বললেন, আপনাদের আর চিন্তা করতে হবে না। আমরা ফাল্গুনীর লেখাপড়ার দায়িত্ব নিলাম। সব সময় ওর পাশে আছি।

স্কুলের সবাই আমাকে এতটাই সাদরে গ্রহণ করল যে মনে হলো, দ্বিতীয় জীবন ফিরে পেলাম। আমি লেখাপড়া শুরু করি। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি লাভ করি। এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পাই। এরপর আমাকে কোথাও থেমে থাকতে হয়নি। আমার পরীক্ষায় সাফল্যের খবর সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে আমাকে নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়। একদিন আমার বাবার কাছে ফোন আসে ঢাকার উত্তরা ট্রাস্ট কলেজ থেকে। আমাকে সেই কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়।

বরিশাল থেকে ঢাকা বহুদূর। তা ছাড়া প্রাইভেট কলেজে লেখাপড়া অনেক ব্যয়বহুল। এত দূরে আমার চলাফেরায় নানা অসুবিধা হবে—এসব বিবেচনায় বাবা রাজি হলেন না। সব শুনে কলেজের প্রিন্সিপাল বললেন, আমরা সম্পূর্ণ বৃত্তি দিয়ে ফাল্গুনীকে পড়াব। তাকে সহায়তা করার জন্য সার্বক্ষণিক আয়া রেখে দেওয়া হবে। বাবা সম্মতি দেন।

আমি উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হই। হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করি। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায়ও জিপিএ-৫ পাই। এবারও আমার সাফল্যের কথা সবখানে ছড়িয়ে পড়ে। আমিও প্রবল উৎসাহে জীবনের নানা চড়াই-উতরাই পার হতে চেষ্টা করি। দেশের অনেক স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান আমার পাশে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ‘প্রথম আলো ট্রাস্ট’ আর ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ থেকে আমি শিক্ষাবৃত্তি লাভ করি।

উচ্চশিক্ষার স্বপ্নে আমি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘জিওগ্রাফি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট’ বিভাগে পড়ার সুযোগ পাই। ঠিক এই সময়ে আমার জীবনে আবার অন্ধকার নেমে আসে। আমার বাবা পৃথিবী থেকে চলে যান। মাথার ওপর থেকে যেন ছায়া সরে গেল। আবার অনিশ্চয়তা, আবার নতুন করে জীবন এগিয়ে নেওয়ার লড়াই শুরু হয়।

মা ঘরে মিষ্টি বানিয়ে বিক্রি করে সংসার চালান। আমি বৃত্তির টাকা দিয়ে চলি। যদি কিছু সঞ্চয় হয়, সেটা সংসারে দিই। ঘরে তো আমার আরও দুই বোন আছে। তাদের লেখাপড়া চালাতে হবে। শত বাধা সত্ত্বেও কখনো দমে যাইনি। এভাবে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করি।

স্বজন ও চারপাশের মানুষদের সহযোগিতা, ভালোবাসা আর সহমর্মিতাই ফাল্গুনী সাহার বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা
ছবি: ব্র্যাকের সৌজন্যে

২০১৯ সালে ব্র্যাকে চাকরির সুযোগ আসে। আমি যোগ দিই এবং ব্র্যাকে অভূতপূর্ব সহযোগিতা পাই। সহকর্মী আর সিনিয়ররা আমাকে আপন করে নেন। অফিস যাতায়াত থেকে শুরু করে দায়িত্ব পালনের জন্য যত রকম সহযোগিতা দরকার, সব পেয়েছি। কিছুদিন যেতেই অনুভব করলাম, সহকর্মীরা আমাকে সহানুভূতি নয়, সম্মান দিয়ে মূল্যায়ন করেন। এ কারণেই আমার কর্মক্ষেত্র একটা বিরাট ভরসার জায়গা। শারীরিক সীমাবদ্ধতা আমাকে কোথাও আটকাতে পারেনি। বিভিন্ন ধাপে কর্মক্ষমতা ও যোগ্যতার প্রমাণ দিয়ে এখন আমি ব্র্যাকের মানবসম্পদ বিভাগে সিনিয়র অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।

এত দূর আসার পেছনে আমার পরিবারের অবদান অনেক। আমার শৈশব ও কৈশোরকালে, যখন তেমন কিছুই করতে পারতাম না, তখন আমার দুই বোন আমাকে সাহায্য করেছে। তখন মনে হতো, আমার নিজের দুই হাত নেই তো কী হয়েছে, আমার দুই বোনের চার হাত আমার নিজেরই।

তবে বিপরীত অভিজ্ঞতাও আছে। কেউ অসহায় হলে দেখবেন কিছু উৎসুক মানুষ অনেক কৌতূহলী হয়। সব নেতিবাচক কৌতূহল। আমার বিয়ে হবে কি না, যদি হয় তাহলে শ্বশুরবাড়ি কীভাবে গ্রহণ করবে—এসব কথা আমার কানেও আসত কিন্তু আমি কখনো সেসবের জবাব দিইনি।

এখন দুই হাত ছাড়াই আমি অনেকের কৌতূহলের জবাব দিতে পেরেছি। জীবনযুদ্ধে আত্মবিশ্বাস ও ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে লড়াই করেছি। বিজয়ী হয়েছি। আমি বিয়ে করে সংসার করছি। আমার স্বামী একজন অসাধারণ মানুষ। আমাদের একটি কন্যাসন্তান আছে। আমি এতটাই ভাগ্যবতী যে আমার শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি মানুষ আমাকে ভীষণ ভালোবাসে এবং সম্মান করে।

আসলে শারীরিকভাবে সীমাবদ্ধ কোনো মানুষকে যদি স্বজনেরা একটু ভালোবাসা আর সহমর্মিতা দেয়, চারপাশের মানুষেরা একটু সহযোগিতার হাত বাড়ায়, তাহলে ওই মানুষটি ভালোভাবে বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা পায়। আমাদের এই ছোট্ট জীবনে অনেক উত্থান-পতন আসে। একটি দুর্ঘটনা আমাদের জীবনকে বদলে দিতে পারে। তখন অনেক কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়। কিন্তু মনোবল হারালে চলবে না। যে কারও জীবনে শারীরিক, মানসিক কিংবা আর্থিক দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে মনোবল জোরদার করে সংকট সামলাতে হবে। নিজেই নিজেকে সাহস দিতে হবে। আমাকে বাঁচতে হবে, সঙ্গে সংশ্লিষ্টদেরও বাঁচানোর চেষ্টা করতে হবে—এভাবে চিন্তা করলেই জীবন সুন্দর হবে।