অধিকারের আলোচনা সভা: অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত অনুষ্ঠানছবি: প্রথম আলো

অন্তর্বর্তী সরকারের সময় বিচারবহির্ভূতভাবে অন্তত ৪০ জন নিহত হয়েছেন। মানবাধিকার সংগঠন অধিকার আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। ওই অনুষ্ঠানের পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনেরা বলছেন, তাঁদের স্বজনদের সঙ্গে কী হয়েছে, তাঁরা বেঁচে আছে নাকি তাঁদের মেরে ফেলা হয়েছে—এসব তথ্য অন্তর্বর্তী সরকার তাঁদের জানাতে পারেনি।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস উপলক্ষে অধিকার এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচনা সভায় নির্ধারিত আলোচক এবং গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনেরা কথা বলেন। আজ বুধবার সকালে রাজধানীর গুলশানে একটি হোটেলে এ সভার আয়োজন করে মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অধিকার।

আলোচনা সভায় গুম কমিশনের সদস্য হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত বিচারপতি মো. ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় কাজ করা সংস্থাগুলো নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং বঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে। সত্য নথিভুক্ত হলে তা ন্যায়বিচারের প্রথম ধাপ হয়ে ওঠে—সত্য কখনো কখনো বেদনাদায়ক হলেও এটি আরোগ্যের পথ দেখায়। আর মিথ্যা তাৎক্ষণিক স্বস্তি দিলেও এর ক্ষতি দীর্ঘস্থায়ী।

তিনি আরও বলেন, গুমবিষয়ক তদন্ত কমিশন সতর্কতার সঙ্গে বিভিন্ন উৎস থেকে প্রমাণ যাচাই করে সত্য উদ্‌ঘাটনের চেষ্টা করছে। সত্য উদ্‌ঘাটনের প্রতি অঙ্গীকার থেকেই আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কারণ, সত্য ছাড়া ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।

আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিভিন্ন ঘটনার তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরেন অধিকারের পরিচালক তাসকিন ফাহমিনা। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের আমলে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের ক্ষেত্রে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। তাঁদের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে অন্তত ৪০টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। যেখানে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও জড়িত ছিল। তবে দোষীদের ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার, সে বিষয়ে এখনো পরিষ্কারভাবে জানা যায়নি।

তিনি আরও বলেন, তবে অন্তর্বর্তী সরকার বেশি কিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে। যেমন আইসিপিপিইডি (বিচারবহির্ভূত নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের অধিকার রক্ষার আন্তর্জাতিক চুক্তি) আইনগতভাবে গ্রহণ ও কার্যকর করা, গুমসংক্রান্ত তদন্ত কমিশন গঠন, নির্যাতন রোধে চুক্তির বিকল্প বা অতিরিক্ত নিয়মাবলি কার্যকর করা হয়েছে। ফলে মানবাধিকারকর্মীরা জেলখানা ও সংশোধনাগার পরিদর্শন করতে পারবেন, যা অতীতে সুযোগ ছিল না।

গুম ও বিচারবহির্ভূত আটক-নির্যাতন নিয়ে কথা বলা অনেক সময় কঠিন, কারণ ভুক্তভোগীরা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার বোঝা বহন করেন বলে জানিয়েছেন গুমের শিকার সাবেক রাষ্ট্রদূত মারুফ জামান। তিনি বলেন, গুমের ঘটনাগুলো সঠিকভাবে নথিভুক্ত ও আলোচিত না হওয়ায় অনেক সত্য আড়ালে থেকে গেছে। দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহার গুমের মতো এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের পরিবেশ তৈরি করেছিল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের প্রসিকিউটর সাইমুম রেজা তালুকদার বলেন, দীর্ঘকাল ধরে মানুষকে নানা নিপীড়ন, হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তখন অনেক মানবাধিকার সংস্থা চুপ ছিল। পরে ছাত্রদের আন্দোলন ও প্রতিবাদ থেকেই রাজনৈতিক সচেতনতা ও গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে। বিচার ও ন্যায়বিচার ধৈর্য, স্বচ্ছতা ও সাক্ষীর যথাযথ প্রমাণের ওপর নির্ভরশীল বলেও জানান তিনি।

পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে গুম হয়েছিলেন আমেনা আক্তারের স্বামী ফিরোজ খান ও দেবর মিরাজ খান। আলোচনায় আমেনা খান বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকার দেড় বছরেরও বলতে পারেনি গুম হওয়া ব্যক্তিরা কোথায়? তাদের কি মেরে ফেলা হয়েছে নাকি তারা বেঁচে আছে। কোনো খবর এখনো পাইনি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল করেছে, গুম কমিশন করেছে। কিন্তু যারা গুম করেছে, তারা আদালতে গিয়ে গান গাইছে, স্বজনদের দেওয়া খাবার খাচ্ছে, হাতের মাসল দেখাচ্ছে। আর আমি আমার স্বামীর পছন্দের খাবার কত দিন তাঁকে খাওয়াতে পারি না।’ তিনি গুমকারীদের দ্রুত বিচার নিশ্চিত চান।

গুমের শিকার ইসমাইল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন জাহান বলেন, ‘আমি আমার স্বামীকে হারিয়েছি। এই সরকারের কাছে প্রত্যাশা ছিল সরকার অন্ততপক্ষে আমাদের কিছু করবে। আমাদের যতটা প্রত্যাশা ছিল, সে জায়গায় আমরা যেতে পারিনি। বিচারও ওভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারিনি।’

আলোচনায় অন্যদের মধ্যে অংশগ্রহণ করেন জনযোগের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম লালা, অধিকারের পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিন, গণ-অভ্যুত্থানে চোখ হারানো খান জসিম, তরুণদের মানবাধিকার সংগঠন অনুকূলের প্রতিনিধি জাহিদুল ইসলাম প্রমুখ।