র‌্যাবের অভিযানের সময় হট্টগোল–গুলি, নিহত ১

স্বামী আবুল কাশেমের মৃত্যুর খবরে জ্ঞান হারান স্ত্রী রমিজা বেগম। তাঁকে ঘিরে বিলাপ স্বজনদের। গতকাল নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের সাদিপুর বরগাঁ এলাকায়
ছবি: গোলাম রাব্বানী

পরিচয় গোপন করে সাধারণ মানুষের বেশে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে খুনের মামলার সন্দেহভাজন এক আসামিকে ধরতে গিয়েছিল র‌্যাবের একটি দল। এ অভিযানকে ঘিরে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে তর্কবির্তকের একপর্যায়ে গুলি করে র‌্যাব। এ ঘটনায় নিহত হন এক ব্যক্তি। গুলিবিদ্ধ হন আরও একজন। গত শুক্রবার গভীর রাতে সোনারগাঁ উপজেলার বরগাঁ এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।

বরগাঁ গ্রামের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যে বাড়িতে নারায়ণগঞ্জের র‌্যাব–১১–এর দলটি অভিযানে গিয়েছিল, সেটি বিয়েবাড়ি। আর যাঁকে ধরতে অভিযানে যায় র‌্যাব, সেই যুবকের বিয়ে হওয়ার কথা আগামী সোমবার। তাঁর নাম মো. সেলিম। তিনি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের একটি পোশাক কারখানার কর্মী।

অন্তত ১০ জন প্রত্যক্ষদর্শী ও ঘটনার শিকার ভুক্তভোগীদের স্বজনেরা বলেছেন, গভীর রাতে সেলিমের বাড়িতে অস্ত্রসহ ‘অপরিচিত কয়েকজনের’ উপস্থিতি এবং হট্টগোলের কারণে প্রতিবেশীসহ আশপাশের মানুষ এগিয়ে আসেন। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রশ্নেও গ্রেপ্তার করতে আসা ব্যক্তিরা তাঁদের পরিচয় প্রথমে দিতে চাননি। এতে স্থানীয় মানুষ ওই ব্যক্তিদের ডাকাত বলে সন্দেহ করেন এবং জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯–এ ফোন করে পুলিশের সাহায্য চান। এরপর স্থানীয় লোকজন ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার করলে বরগাঁ গ্রামের আরও লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন নিজেদের র‌্যাব সদস্য বলে পরিচয় দেন অভিযানে যাওয়া ব্যক্তিরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, স্থানীয় লোকজন ‘ডাকাত ডাকাত’ চিৎকার শুরু করার পর র‌্যাব সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এ সময় দুজন গুলিবিদ্ধ হন। তাঁদের মধ্যে ৬৫ বছর বয়সী আবুল কাশেম ঘটনাস্থলেই মারা গেছেন। তিনি বাঁশের টুকরি বোনার কাজ করতেন। আর গুলিবিদ্ধ হুমায়ুন কবিরের (৫৮) ওষুধের দোকান রয়েছে। তাঁর দুই পায়ে গুলি লেগেছে। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন গুলিবিদ্ধ হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর প্রতিবেশী মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করার খবর শুনে তিনি তাঁর বাড়িতে যান। তখন তিনিও গ্রেপ্তার করতে আসা ব্যক্তিদের পরিচয় জানতে চান। তখন সেখানে হট্টগোল শুরু হয়। একপর্যায়ে তিনি সরে আসতে চেয়েছিলেন। এ সময় হঠাৎ তাঁর পায়ে গুলি লাগে।

ঘটনার বিষয়ে সোনারগাঁ থানার পুলিশ জানায়, রোজিনা আক্তার (৩৪) নামের এক নারীকে খুনের ঘটনায় করা মামলায় মো. সেলিমকে গ্রেপ্তার করতে র‌্যাবের দলটি বরগাঁ এলাকায় গিয়েছিল। শুক্রবার সকালে সোনারগাঁয়ের তালতলা বাজার এলাকা থেকে ওই নারীর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। রোজিনার বাড়ি রূপগঞ্জ উপজেলায়। তিনিও পোশাক কারখানায় কাজ করতেন।

সরেজমিনে যা জানা গেল

গতকাল দুপুরে বরগাঁ এলাকায় সেলিমদের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, উঠানে কয়েকটি বাঁশ পুঁতে রাখা। বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য শামিয়ানা টানানোর প্রস্তুতির অংশ হিসেবে এসব বাঁশ পুঁতে রাখা হয়েছিল বলে তাঁর স্বজনেরা জানান।

নিজেকে সেলিমের ভাবি পরিচয় দেওয়া তাসলিমা আক্তার নামের এক নারী জানান, আগামী সোমবার সেলিমের বিয়ে। তাই বাড়িতে আয়োজন চলছিল। এরই মধ্যে শুক্রবার মধ্যরাতে কিছু লোক এসে কোনো কথা না বলেই বাড়ির দরজা–জানালায় আঘাত করতে থাকেন। এত রাতে হইহুল্লোড় শুনে সেলিমের বৃদ্ধ বাবা (আমীর আলী। তিনি বাঁশ–বেতের কাজ করতেন) ঘর থেকে বের হয়ে এলে তাঁকে মারধর করেন ওই ব্যক্তিরা। তাঁরা সেলিমের খোঁজ জানতে চান। পরে সেলিম এলে তাঁকে নিয়ে যেতে চান ওই ব্যক্তিরা। এ সময় তিনিসহ আশপাশের এলাকার লোকজন এগিয়ে এসে তাঁদের পরিচয় জানতে চাইলে তাঁরা পরিচয় না দিয়ে উপস্থিত লোকজনকে ভয়ভীতি দেখান। এ নিয়ে তাঁদের সঙ্গে দীর্ঘ বাদানুবাদ হয়।

তাসলিমা আক্তারের সঙ্গে কথা বলার সময় সেখানে উপস্থিত এক ব্যক্তি এই প্রতিবেদককে গত শুক্রবার রাতের ঘটনার দুটি ভিডিও মুঠোফোনে দেখান।

ভিডিও চিত্রে যা দেখা গেল

৭ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের ওই ভিডিওতে দেখা যায়, মো. সেলিমের বাড়ির সামনে মানুষের জটলা। গ্রেপ্তার করতে আসা ব্যক্তিদের সঙ্গে তর্কবিতর্ক হচ্ছে। তখন একটি নারী কণ্ঠ বলছে, ‘আপনেরা যে ডাকাইত না, এটা কেমনে নিশ্চিত হমু? আপনারা আইনের লোক হইলে পরিচয় দেন। রাইত বারোটার পর এভাবে আসামি ধরা নিষেধ। ওয়ারেন্টের আসামি হইলেও কাগজ দেখাইতে হইব।’

এ সময় একটি পুরুষ কণ্ঠকে বলতে শোনা যায়, ‘এই চুপ থাকেন। এমন কিছু করব যে সারা জীবন বাইরে থাকা লাগবেনে।’

এ সময় নারী কণ্ঠটি আবার তাঁদের পরিচয় জানতে চান। তিনি বলেন, ‘আপনেরা আইসা ভাঙচুর কেন করবেন? পরিচয় দেন।’ তখন পুরুষ কণ্ঠটি বলে, ‘একদম কোনো কথা হবে না। চুপচাপ থাকেন৷’

তখন ওই নারী কণ্ঠ বলেন, ‘পরিচয় না দিয়া ওরে নিতে পারবেন না। বাইর কইরা নিতে চাইলে পরিচয় দিতে হইব।’

৭ মিনিটের আরও একটি ভিডিওতে স্পষ্ট কিছু দেখা যাচ্ছিল না। অন্ধকারের মধ্যে শুধু নারী–পুরুষ ও শিশুদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। অপরদিকে একের পর এক গুলির শব্দ। এই ভিডিওতে অন্তত ১৮টি গুলির শব্দ শোনা গেছে।

হইচই শুনে এগিয়ে এসে নিহত হন বৃদ্ধ

মো. সেলিমের তিন ঘর পরই নিহত আবুল কাশেমের বাড়ি। গতকাল বিকেলে এই প্রতিবেদক সেখানে গিয়ে কথা বলেন কাশেমের স্ত্রী রমিজা বেগমের সঙ্গে। কান্না থামিয়ে তিনি বলেন, ‘দেখি সেলিমরে নিয়া যাইতাছে। সেলিম কানতাছে। ওনি (কাশেম) আগাইয়া গিয়া ওনাগো (গ্রেপ্তার করতে আসা ব্যক্তিরা) পরিচয় জানতে চায়। ওনারা কোনো কথা না কইয়া ধাক্কা দিয়া ফালাইয়া দেয়। তখন আমার ছেলে দৌড়াইয়া গিয়া ওনারে ধরে। মারধর করতাছে দেইখা পিছনে থাকা সেলিমের বাড়ির লোকজন ডাকাইত কইয়া চিল্লান দেয়। তখন ওই লোকজন নিজেগো র‌্যাব কয়। গুলি করে।’

সোনারগাঁ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার দিবাগত রাত তিনটায় গুলিবিদ্ধ এক বৃদ্ধকে (আবুল কাশেম) হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর নাভির ওপরে একটি বুলেটের চিহ্ন ছিল।

যা বলছে র‌্যাব

র‍্যাব-১১–এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত শুক্রবার সোনারগাঁয়ে এক নারীর গলাকাটা লাশ পাওয়া যায়। সেই হত্যাকারীকে আমরা শনাক্ত করি এবং সেই আসামি সেলিমকে ধরতেই বরগাঁ এলাকায় অভিযান চালাই আমরা। আসামিকে নিয়ে আসার সময় কিছু দুষ্কৃতকারী আসামিকে ছিনিয়ে নিতে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র নিয়ে র‌্যাবের ওপর হামলা করে, গুলি করে তখন আত্মরক্ষার্থে র‌্যাব পাল্টা গুলি ছোড়ে।’

ওই সময় কেউ হতাহত হয়েছেন কি না, তা জানা নেই বলে জানান র‍্যাব-১১–এর অধিনায়ক তানভীর মাহমুদ পাশা। পরে গতকাল সকালে জানতে পারেন, একজন গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন এবং একজন আহত আছেন। তিনি বলেন, র‌্যাবের চারজন সদস্য আহত আছেন। তাঁদের মধ্যে দুজনের অবস্থা গুরুতর। তবে তাঁরা গুলিবিদ্ধ নন। একজনের মাথার খুলিতে গভীর ক্ষত হয়েছে। তিনি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।

অভিযানে গিয়ে র‌্যাব সদস্যদের পরিচয় না দেওয়ার বিষয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল তানভীর মাহমুদ পাশা বলেন, ‘এটা দুষ্কৃতকারীদের এক্সকিউজ (অজুহাত)। আমাদের পরে ডিবি ও জেলা পুলিশও সেখানে গিয়েছিল। সকলেই জানে এখানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হত্যা মামলার আসামিকে ধরতে গিয়েছিল। তাকে ছিনিয়ে নিতেই স্বজনেরা আমাদের ওপর হামলা করেছে। পরে সেলিমকে আটক করা হয়েছে। সেলিমের সঙ্গে খুন হওয়া নারীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল।’

কিশোরসহ ২০ জন আটক

বরগাঁ এলাকার অন্তত ১২ জনের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাঁরা বলেছেন, গুলিতে আবুল কাশেম নিহত হওয়ার খবর পেয়ে এলাকাবাসী লাঠিসোঁটা নিয়ে তাঁর বাড়ির দিকে যান। ক্ষুব্ধ লোকজন র‌্যাবের ওপর হামলার চেষ্টা করেন। তখন র‌্যাব গুলি করতে থাকলে লোকজন পালিয়ে যান। এরপর শুক্রবার রাত দুইটার দিকে সোনারগাঁ থানার পুলিশ ও সাদিপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য মো. মাইনুদ্দীন ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন। পুলিশ গ্রামবাসীকে অভয় দিয়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে চায়। গ্রামবাসী পুলিশের সঙ্গে কথা বলতে এগিয়ে এলে র‌্যাব-১১–এর পোশাকধারী বেশ কিছু সদস্যকে ঘটনাস্থলে দেখতে পায়। এ সময় র‌্যাব সদস্যরা স্থানীয় কয়েকজনকে আটকের চেষ্টা করেন।

স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, শুক্রবার গভীর রাত পর্যন্ত র‌্যাব সদস্যরা বরগাঁ গ্রামে অবস্থান করেন এবং বিভিন্ন বাড়িঘরে তল্লাশি চালান। পরে তাঁরা প্রায় ২০ জনকে আটক করে নিয়ে যান। আটক করা ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন নিহত আবুল কাশেমের বড় ছেলে নজরুল ইসলাম, তিন ভাতিজা মো. আমান উল্লাহ, মাহমুদউল্লাহ, মো. জাহাঙ্গীর ও কিশোর বয়সী এক নাতি। এর মধ্যে নাতিকে গতকাল সন্ধ্যায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

মো. মোশারফ নামে আবুল কাশেমের এক স্বজন গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, ভয়ে শুক্রবার গভীর রাত থেকে গ্রামের পুরুষ ও কিশোরেরা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। তারপর থেকেই এলাকা প্রায় পুরুষশূন্য।

ডাকাত ভেবে ৯৯৯-এ ফোন

বৃদ্ধ আবুল কাশেমের বাড়ির ১০০ গজ দূরেই ওষুধের দোকানের মালিক হুমায়ুন কবিরের বাড়ি। ডাকাত বলে চিৎকার ও গুলির শব্দ শুনে তাঁর ছেলে আজিজুল ইসলাম সাহায্য চেয়ে ৯৯৯–এ ফোন করেন। পরে তাঁরা দুজন বাড়ির বাইরে এগিয়ে যান।

হুমায়ুন কবিরের মেয়ে লাকি আক্তার বলেন, ‘আব্বা বাইর হইতে হইতে এলাকার অনেকেই লাঠিসোঁটা নিয়া আগাইয়া আসে। ততক্ষণে কাশেম দাদার গুলি লাগছে। আব্বা আাগাইয়া যাইতেই কোনো কথা না বইলা তারা আব্বার দুই পায়ে গুলি করে। ভাই আব্বারে হাসপাতালে নিয়া যায়। আমরা ভয়ে ঘরের ভিতরে চইলা আসি।’

লাকি আক্তার বলেন, তাঁর ভাই আজিজুল তখন ৯৯৯–এ ফোন করেছিল।

অবশ্য সোনারগাঁ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মো. ইউনূস গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, শুক্রবার মধ্যরাতে কয়েকজন ৯৯৯-এ ফোন করেছিলেন। তাঁরা হুমকি-ধমকির অভিযোগ করেছিলেন ওই নম্বরে। তবে ডাকাতির অভিযোগ কেউ করেনি। ঘটনাটি থানা–পুলিশের টহল দলকে জানিয়েছিলেন তিনি। তবে ওই টহল দল ঘটনাস্থলে গিয়েছিল কি না তা জানা নেই তাঁর।