রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে বিপুল উৎসব

জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলনের উদ্বোধন অনুষ্ঠান শুরু হয়েছিল শিল্পীদের সংগীতের সঙ্গে সমবেত নৃত্য পরিবেশনার মধ্য দিয়ে।ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

গানের সুর আর সারা দেশ থেকে আসা শত শত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পীর পদচারণে মুখর হয়ে উঠেছে ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি–ভবন। মিলনায়তনে চলছে গান। নিচের তলায় নাম নিবন্ধনের জন্য টেবিল পেতে বসেছেন কর্মীরা। অংশ নিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরা সেখানে নাম নিবন্ধন করছেন। ভবনের সামনে, মিলনায়তনের প্রবেশদ্বারে চেনাজানাদের দেখা পেয়ে চলছে কুশল বিনিময়।

উৎসবের আমেজ নিয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে সম্মেলক কণ্ঠে পরপর তিনটি গান দিয়ে সূচনা হয়েছিল সম্মেলনের। রবীন্দ্রসংগীত ‘এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে’, নজরুলসংগীত ‘নাই ভয় নাই ভয়’, এবং লালন সাঁইয়ের গান ‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি’ পরিবেশনা দিয়ে শুরু হলো ৪৩তম জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন।

জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের আয়োজনে তিন দিনের সংগীত উৎসব চলবে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত। এবারের সম্মেলনে অংশ নিচ্ছেন দেশের নানা অঞ্চল থেকে আসা পাঁচ শতাধিক শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠক।

সম্মেলনে স্বাগত বক্তব্য দেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সম্পাদক তানিয়া মান্নান। উদ্বোধন করেন সংগীতগুণী ফাহমিদা খাতুন। তাঁকে ফুলেল শুভেচ্ছা জানিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে দেন উদ্বোধনী অধিবেশনের সভাপতি সারওয়ার আলী।

ফাহমিদা খাতুনকে উত্তরীয় পরিয়ে দিচ্ছেন সারওয়ার আলী ও তানিয়া মান্নান।রাজধানীর ছায়ানট–ভবন মিলনায়তনে
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

উদ্বোধনী বক্তব্যে ফাহমিদা খাতুন বলেন, ‘জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন সভ্যতা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত রাখতে ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতির ওপরে যখনই আঘাত এসেছে সেই ১৯৫২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত, এ দেশের মানুষ বুকের রক্ত দিয়ে তার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। প্রতিরোধ করেছেন। সমাজের বিভেদ–বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে বড় রকমের সামাজিক ঐক্য গড়ে তোলার জন্য এ ধরনের আয়োজন বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।’

সভাপতির বক্তব্যে সারওয়ার আলী বলেন, ‘দেশভাগের পরে অনেক গুণী শিল্পী ভারতে চলে যাওয়ায় এখানে শিল্পীদের সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ফাহমিদা খাতুন ও জাহিদুর রহিমের মতো গুণী শিল্পীরা সারা দেশে রবীন্দ্রসংগীতের প্রসার ও চর্চায় বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। প্রয়াত জাহিদুর রহিমের স্মৃতি নিয়েই এই সংগঠনের কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। আজ এই সম্মেলন উদ্বোধন করলেন ফাহমিদা খাতুন। এ ঘটনা এবারের সম্মেলনে একটি বিশেষ তাৎপর্য সৃষ্টি করল।’

সারওয়ার আলী বলেন, অনেক আত্মদানের বিনিময়ে মুক্ত সমাজে সবার অধিকারের মান্যতা প্রতিষ্ঠার যে আকাঙ্ক্ষা আজ সর্বজনীন হয়ে উঠেছে, তার বাস্তব রূপদান এখন একান্ত জরুরি।

স্বাগত বক্তব্যে তানিয়া মান্নান বলেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর নানা রচনা ও ভাষণে সমাজে মানবিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। সমাজের নানা ঘাত-প্রতিঘাতের ক্ষত সারিয়ে তোলার পরামর্শ রেখেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, রবীন্দ্রনাথের কর্ম ও জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজে মুক্তিযুদ্ধের ভাবাদর্শ প্রতিষ্ঠা এবং বাঙালি সংস্কৃতির নির্বিঘ্ন যাত্রা নিশ্চিত করা সম্ভব।’ এবারের সম্মেলনে সম্প্রতি প্রয়াত গুণী সংগীতশিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে রবীন্দ্র পদক দিয়ে সম্মাননা জানানো হবে বলে জানান তিনি।

প্রথম দিনের অধিবেশন

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর প্রথম দিনের অধিবেশন শুরু হয়েছিল গীতি–আলেখ্য ফিরে চল মাটির টানে পরিবেশনা দিয়ে। গীতি–আলেখ্যটি গ্রন্থনা করেন সন্তোষ ঢালী, সংগীত পরিচালনায় ছিলেন শিল্পী বুলবুল ইসলাম। পাঠে ছিলেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ত্রপা মজুমদার। একক ও সম্মেলক গানের পাশাপাশি ছিল নৃত্য পরিবেশনা। নৃত্য পরিবেশন করেন নৃত্যনন্দন, নৃত্যম, নৃত্যশীলন ও ধৃতি নর্তনালয়-এর শিল্পীরা।

গানগুলোর মধ্যে ছিল ‘আমি মারের সাগর পাড়ি দেব’, ‘সংকোচের বিহ্বলতা’, ‘ফিরে চল মাটির টানে’, ‘ভুবনেশ্বর হে’–এর মতো অনেক গান। গানের ফাঁকে ফাঁকে ছিল কবিতা আবৃত্তি।

পরে ছিল একক কণ্ঠের গান। শুরু হয়েছিল রোকাইয়া হাসিনার পরিবেশনায় ‘ধায় যেন মোর সকল ভালোবাসা’ দিয়ে। এরপরের শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন অশোক সাহা, আকলিমা খাতুন, শুক্লা পাল, ফেরদৌস আরা, সুস্মিতা আহমেদ, প্রতীক এন্দ, পার্থ প্রতীম রায়, কল্লোল সেনগুপ্ত, নাইমা ইসলাম, মাইনুল ইসলাম, অনুপম বসাক, সমাপ্তি রায়, আইরিন পারভিন, অসীম দত্ত ও শ্রাবণী মজুমদার।

এ ছাড়া সম্মেলক গান পরিবেশন করেন জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, চাঁদপুর শাখার শিল্পীরা। নৃত্য পরিবেশন করেন শিল্পী মুনমুন আহমেদ, আবৃত্তি পরিবেশন করেন ডালিয়া আহমেদ।

আজকের অনুষ্ঠান

আগামীকাল শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের প্রভাতি অধিবেশন শুরু হবে সকাল সাড়ে নয়টায়। এতে থাকবে সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি। বেলা তিনটায় প্রতিনিধি সম্মেলন। বিকেল চারটায় ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ’ শীর্ষক সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে। মূল প্রবন্ধ পড়বেন অধ্যাপক ফকরুল আলম। আলোচনা করবেন আলম খোরশেদ ও হামীম কামরুল হক। সভাপতিত্ব করবেন সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি মফিদুল হক। সন্ধ্যা সাড়ে পাঁচটায় প্রদীপ প্রজ্বালন, সংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তি পরিবেশিত হবে।

শনিবার নিয়মিত অধিবেশন ছাড়াও একটি বিশেষ অনুষ্ঠান হবে বেলা সাড়ে তিনটায় শ্যামলীর এসওএস শিশুপল্লিতে।

এ ছাড়া এবার থাকছে সম্মিলন পরিষদের এ পর্যন্ত সব কার্যক্রমের উপস্থাপনা। বিশিষ্টজনদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হবে প্রবন্ধ ‘সংগীত সংস্কৃতি’।

শুরুর কথা

বিশিষ্ট রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী জাহিদুর রহিমের প্রয়াণদিবসে ১৯৭৯ সাল থেকে ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পরিষদ’-এর কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। পরে সারা দেশে আরও বড় পরিসরে কাজের জন্য সংগঠনের নাম পরিবর্তন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ করা হয়। এখন সম্মিলন পরিষদের ৮২টি শাখা রয়েছে। নাম পরিবর্তন করা হলেও জাহিদুর রহিমের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য নবীন প্রজন্মের শিল্পীদের জন্য প্রতিযোগিতাভিত্তিক ‘জাহিদুর রহিম স্মৃতি পুরস্কার’ প্রবর্তন করা হয়।

প্রতিষ্ঠার পর প্রথম দিকের বার্ষিক অধিবেশনগুলো কেবল রাজধানী ঢাকাতেই হতো। শাখাগুলো সক্রিয় করতে ১৯৮৪ সাল থেকে এক বছর ঢাকায়, পরের বছর অন্য জেলায় সম্মেলন হচ্ছে। তবে সংগীত প্রতিযোগিতা হচ্ছে কেবল ঢাকায়। প্রতি অধিবেশনেই দেশের গুণীজনদের সম্মাননা প্রদান করা হচ্ছে।