মানহানি মামলা কি হয়রানির হাতিয়ার

প্রতীকী ছবি

সম্প্রতি বাংলাদেশ ও প্রতিবেশী ভারতে মানহানি মামলা নিয়ে বেশ কিছু খবর পাওয়া গেছে। ভারতে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীর দুই বছরের সাজা হয়েছে মানহানি মামলায়। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অভিনেতা শাকিব খান এক প্রযোজকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছেন। এদিকে প্রায় একই রকম অপরাধে অভিনেত্রী মাহিয়া মাহির বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা ও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কারও বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা করলে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে ভুল তথ্য দিয়ে কারও সুনাম নষ্ট করলে কিংবা মিথ্যা খবর প্রকাশ করে কাউকে হেয় করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা হিসেবে মানহানির মামলা করা যায়। কিন্তু আমাদের দেশে মানহানির মামলা নিয়ে নানা রকম প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, বেশির ভাগ সময় হয়রানি করার জন্যই মানহানি মামলা করা হয়। তা ছাড়া মানহানিকে ফৌজদারি অপরাধ হিসেবে আমলে নেওয়ার বিষয়টি নিয়েও ভিন্নমত রয়েছে।

মানহানি মামলা

মানহানির বিরুদ্ধে দেওয়ানি ও ফৌজধারি উভয় কার্যবিধিতে ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আমাদের আইনি ব্যবস্থায় মানহানির ফৌজধারি মামলার প্রধান উৎস হলো ১৮৬০ সালে প্রণীত দণ্ডবিধির ৪৯৯ ও ৫০০ ধারা। দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় মানহানির সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি অন্য ব্যক্তির খ্যাতি বা সুনাম নষ্ট করার জন্য উদ্দেশ্যমূলক শব্দাবলি বা চিহ্নাদি বা দৃশ্যমান প্রতীকের সাহায্যে কোনো ব্যক্তি সম্পর্কে এমনভাবে কোনো নিন্দা প্রণয়ন বা প্রকাশ করে, তাহলে ওই ব্যক্তির মানহানি হয়েছে মর্মে গণ্য হবে। এই ধারা অনুযায়ী মৃত ব্যক্তিরও মানহানি হতে পারে। মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন মানহানির মামলা করতে পারবেন। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম রয়েছে। জনগণের কল্যাণে, সরকারি কর্মচারীর সরকারি কোনো কাজে তার আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, আদালতের কার্যবিবরণী বা প্রতিবেদন প্রকাশ করলে, জনসমস্যা বিষয়ে বা কোনো ব্যক্তির আচরণ সম্বন্ধে সরল বিশ্বাসে কিছু বললে, গণ–অনুষ্ঠানের অনুষ্ঠানসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে মন্তব্য করলে, সরল বিশ্বাসে যথাযথ কর্তৃপক্ষের নিকট অভিযোগ দায়ের করলে এবং আদালতের সিদ্ধান্তে মামলার দোষ, গুণ নিয়ে সরল বিশ্বাসে কথা বললে মানহানি হবে না।

মানহানির সাজা

প্রতীকী ছবি

দণ্ডবিধির ৫০০ ধারায় মানহানির শাস্তি বর্ণনায় বলা হয়েছে, এই অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হলে দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হতে পারে। অন্যদিকে দণ্ডবিধির ৫০১ ও ৫০২ ধারা অনুসারে, মানহানিকর বলে পরিচিত বিষয় মুদ্রণ বা খোদাইকরণ সম্পর্কে এবং এর শাস্তি বর্ণিত হয়েছে। মানহানিকর বক্তব্য যদি অনলাইনের বাইরে হয়, তাহলে একধরনের শাস্তি আর অনলাইনে হলে আরেক ধরনের শাস্তি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮–এর ২৯ ধারার অধীনে মামলা করা হলে এবং মানহানিকর কোনো তথ্য-উপাত্ত প্রমাণিত হলে অভিযুক্ত ব্যক্তির জন্য ৩ (তিন) বছরের কারাদণ্ড ও ৫ (পাঁচ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই মানহানি ডিজিটাল মাধ্যমে হতে হবে। অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি পুনরায় একই অপরাধ করেন তবে ৫ (পাঁচ) বছরের কারাদণ্ড ও ১০ (দশ) লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

মানহানি মামলা কি হয়রানির হাতিয়ার

আমাদের দেশে দায়ের হওয়া মানহানি মামলাগুলো বিশ্লেষণ করলে মনে হতে পারে, বেশির ভাগ মামলা শুধু হয়রানি করার জন্যই করা হয়। সাধারণত যে উদ্দেশ্য নিয়ে সাধারণ নাগরিকেরা আইনের আশ্রয় নিতে চান, মানহানির মামলায় তা অনুপস্থিত। কারণ, মানহানি মামলা নিম্ন আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে বা রায় হয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত নেই বললেই চলে। দণ্ডবিধিতে মানহানি একটি লঘু ও আপসযোগ্য অপরাধ হলেও দেখা যাচ্ছে, কাউকে মানহানি মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে জেল পর্যন্ত খাটতে হয়েছে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনের বিরুদ্ধে ২০১৮ সালে অন্তত ২০টি মানহানি মামলা হয়। এসব মামলায় তাঁর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ দাবি করা হয় ২৫ হাজার কোটি টাকা। তিনি বেশ কিছুদিন জেলও খাটেন। ২০১৬ সালে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের বিরুদ্ধে সারা দেশে ৭০টির বেশি মামলা করা হয়।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৮ ধারাতে স্পষ্ট বলা আছে, মানহানি মামলায় সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি ও বিশেষ ক্ষেত্রে ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিনিধি ছাড়া মামলা করার সুযোগ নেই। আইন অনুযায়ী, যার মানহানি হয়েছে তিনিই মামলা করতে পারবেন, অন্য কেউ নয়। এ ছাড়া একই অপরাধে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা যায় না। কিন্তু মানহানি মামলার ক্ষেত্রে দেখা গেছে, নির্দিষ্ট একজন ব্যক্তির বিষয়ে কথা বলা হয়েছে, কিন্তু অনেকে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন বলে দাবি করেছে। এ নিয়ে বিভিন্ন স্থানে মামলা করা হচ্ছে ও বিজ্ঞ বিচারকেরা তা আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন। এটা আমাদের প্রচলিত বিচারব্যবস্থার দুর্বলতার একটি প্রমাণ।

প্রতীকী ছবি

মানহানি কি দেওয়ানি ভুলের অপরাধীকরণ

একজন ব্যক্তি কর্তৃক অপর ব্যক্তির মানহানি একটি সিভিল ভুল বা টর্ট। এটা প্রচলিত ফৌজদারি বিচারব্যবস্থার ব্যতিক্রম। ফৌজদারি ব্যবস্থায় একজনের বিরুদ্ধে অপরাধ হলে পুরো সমাজ বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ করা হয়েছে বলে গণ্য করা হয়। এ জন্য রাষ্ট্র বাদী হয়ে মামলা করে। কিন্তু মানহানির মামলায় রাষ্ট্র কোনো পক্ষ হয়ে মামলা করে না। ইংল্যান্ডে একসময় মানহানি ফৌজদারি অপরাধ ছিল। তবে সময়ের পরিক্রমায় ইংল্যান্ড ও ওয়েলসে মানহানিকে এখন শুধু একটি দেওয়ানি ভুল হিসেবে গণ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকার সনদ অনুযায়ীও মানহানি শুধু একটি দেওয়ানি ভুল। কিন্তু বাংলাদেশ, ভারতসহ সাবেক ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক বেশ কিছু রাষ্ট্রে মানহানি এখনো ফৌজদারি অপরাধ।

আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রত্যেক নাগরিকের বাক্ ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। অথচ দণ্ডবিধির ৪৯৯, ৫০০ ধারা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮, ২৯ ধারা নাগরিকের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করার অধিকারকে অনেকটাই খর্ব করা হয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সরকারব্যবস্থার প্রধান মানদণ্ড হলো তার নাগরিককে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশ করতে দেওয়া। আমাদের দেশে প্রচলিত মানহানির অপরাধীকরণ স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অন্যতম প্রধান প্রতিবন্ধক। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী মানহানিকে শুধু একটি দেওয়ানি ভুল হিসেবে চিহ্নিত করা এখন সময়ের দাবি।

কাইয়ুম আহমেদ আইনজীবী