মনের সুস্থতায় সচেতন হই

মানসিক অসুস্থতা কিশোর ও তরুণদের আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মতো বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দিতে পারে।

মনোজ কুমার রায়, মো. শফিকুল ইসলাম, কামাল ইউ এ চৌধুরী ও মো. মোখলেছুর রহমান
ছবি: প্রথম আলো

হতাশা অথবা বিষণ্নতায় ভুগলে দ্বিধা ঝেড়ে ফেলে সেবা নিতে মানসিক স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে হবে। মনের যত্ন না নিয়ে অসুস্থতা পুষে রাখলে তা কিশোর ও তরুণদের আত্মহত্যা, মাদকাসক্তি ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ার মতো বিপজ্জনক দিকে ঠেলে দিতে পারে। শিশু, কিশোর ও তরুণদের মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে পরিবারগুলোকে সচেতন হতে হবে।

রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে গতকাল রোববার আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে এসব কথা বলেন বক্তারা। ‘পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে শিশু ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য: চ্যালেঞ্জ ও পরিকল্পনা’ শিরোনামে গোলটেবিল বৈঠকটির যৌথ আয়োজক এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কমিনিউটিভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা প্রকল্প, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিট ও প্রথম আলো। এতে সহযোগিতা করেছে ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশন এবং ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশন।

অনুষ্ঠানে বক্তারা সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয় করে সমাজভিত্তিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুলতে সচেতনতা সৃষ্টির ওপর জোর দিয়েছেন।

অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক হেলাল উদ্দিন আহমেদ। তিনি জানান, রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক, প্রযুক্তির উৎকর্ষ, নগরায়ণ, জলবায়ু পরিবর্তন ও শান্তি-সংঘর্ষ এবং নতুন করে যুক্ত হওয়া কোভিড মহামারির মাধ্যমে এক পরিবর্তনশীল বিশ্ব এখন সবার সামনে। বৈশ্বিক এই পরিবর্তনের প্রভাব পড়ছে কিশোর-তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য, ভাবনা, আচরণ, বিশ্বাস, মূল্যবোধ ও লক্ষ্যে। মাদক ও মুঠোফোনের মতো ডিভাইসে আসক্তি, আত্মহত্যা এবং নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা বেড়েছে। তিনি বলেন, ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে মানসিক রোগ ১৪ বছর বয়সের আগে এবং ৭৫ শতাংশ ক্ষেত্রে ২৫ বছর বয়সের আগে শুরু হয়। অথচ মানসিক সমস্যা আছে, এমন কিশোর ও তরুণদের ৯৪ শতাংশ চিকিৎসাসেবার বাইরে থেকে যাচ্ছে। দেশে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী হাজারখানেকও নেই।

বৈঠকে প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) মনোজ কুমার রায় বলেন, মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিচ্ছিন্নভাবে সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলো প্রচুর কাজ করছে। ভালো ফল পেতে সংস্থাগুলোর কাজের মধ্যে সমন্বয় আনা দরকার। তিনি বলেন, কিশোর ও তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে বাবা-মায়েরা যেন সন্তানদের সময় দেন, তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন।

সভাপতির বক্তব্যে এডিডি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, মানসিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়গুলোকে কমিউনিটি পর্যায়ে আলোচনায় আনা দরকার। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে সেবা কোথায় পাওয়া যায়, সে তথ্য ছড়িয়ে দিতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক এবং নাসিরুল্লাহ সাইকোথেরাপি ইউনিটের পরিচালক কামাল ইউ এ চৌধুরী বলেন, গবেষণায় দেখা গেছে, চার ধরনের মানুষ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নেওয়া থেকে দূরে থাকে—যাঁরা মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে কিছু জানেন না, যাঁরা মনে করেন এটা পাপের শাস্তি, যাঁরা জানলেও চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে কবিরাজ, ওঝার শরণাপন্ন হন এবং সামর্থ্য না থাকায় যাঁরা জানেন না ঠিক কোথায় গেলে যথাযথ চিকিৎসা পাওয়া যাবে।

বিনোদনমূলক শিক্ষার মাধ্যমে শিশু-কিশোরদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখার ওপর জোর দেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্যশিক্ষা ব্যুরোর প্রধান (ভারপ্রাপ্ত) মো. মোখলেছুর রহমান। তিনি বলেন, চলতি অর্থবছরে স্কুল পর্যায়ে মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে পাঁচ হাজার বই বিতরণ করা হবে। শিক্ষকেরা সপ্তাহে দুই দিন শিক্ষার্থীদের বইটি পড়াবেন।

আইসিডিডিআরবির ইমেরিটাস বিজ্ঞানী জেনা দারাকসানি হামাদানি বলেন, কিছু সামাজিক চর্চা শিশু অবস্থায় আরোপ করতে দেখা যায়। ছেলেদের জন্য কাঁদা লজ্জার, মেয়েদের জোরে কথা বলা উচিত না ইত্যাদি। এ ধরনের চর্চা ছেলেমেয়েদের আচরণে প্রভাব ফেলে।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের বাংলাদেশে শিশু সংবেদনশীল সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পের (সিএসপিবি) সহকারী প্রকল্প পরিচালক মো. এমরান খান সমাজকর্মের উন্নয়ন ও সমাজকর্মীদের সম্পৃক্ততার মাধ্যমে শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিরোধ করা সম্ভব বলে উল্লেখ করেন।

জায়গা পেলে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত তরুণেরা সেবা নিতে আসেন বলে জানিয়েছেন ইনোভেশন ফর ওয়েলবিয়িং ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক মনিরা রহমান। তিনি বলেন, অনেক মানুষ আত্মহত্যার চিন্তা করে। যথাযথ পরামর্শ ও সেবা পেলে আত্মহত্যার চিন্তা করা মানুষের মনোভাব পরিবর্তন করা সম্ভব।

গোলটেবিল বৈঠকে স্বাগত বক্তব্য দেন প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম। তিনি বলেন, মানসিক সমস্যা কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, এর চ্যালেঞ্জগুলো শনাক্ত করে সমস্যার সমাধান করতে হবে।

ডিজঅ্যাবল্ড চাইল্ড ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা নির্বাহী পরিচালক নাসরিন জাহান সরকারি মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালগুলোয় প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকা দরকার বলে উল্লেখ করেন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার জাতীয় পেশাদার কর্মকর্তা (মানসিক স্বাস্থ্য) হাসিনা মমতাজ বলেন, আবেগপ্রবণ ও শারীরিক পরিবর্তনের সময় মানুষের আচরণ, কথা শিশু–কিশোরদের ওপর প্রভাব ফেলে।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্টের (আইইইডি) মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা শাখার ডেপুটি লিড মো. তাইফুর ইসলাম বলেন, শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে সুন্দর পরিবেশ নিশ্চিত হওয়া জরুরি।

আঁচল ফাউন্ডেশনের রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট টিম লিডার সৈয়দ সালমান হায়দার বলেন, ঘন ঘন পরীক্ষা ও পরীক্ষার ফল নিয়ে দুশ্চিন্তায় কিছু শিক্ষার্থীর মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেড়েছে।

অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভের ছাত্র কক্সবাজারের ছেনক্য রাখাইন ভালো বন্ধুর অনুপস্থিতিতে তাঁর কী রকম মানসিক সংকট তৈরি হয়েছিল, তা জানান।

গোলটেবিল বৈঠকের সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।