বিরল রোগ: চোখের সামনে সন্তান অচল হয়ে পড়লেও কিছু করার থাকে না মা–বাবার
মাথাভর্তি চুল। মুখে কথা লেগে আছে। সারাক্ষণ কিছু না কিছু বলছে। বাবাকেও প্রশ্ন করে চলেছে। গান গাইছে একটার পর একটা। বাবার কোলে থাকা শিশুটি সবই করছে ঠিকঠাক। মনে প্রশ্ন জাগে, ও পারে না কী?
পারে না শুধু দাঁড়াতে, হাঁটতে। সোজা হয়ে বসতে পারে না। বসলে মাথা ঢলে পড়ে। এই বয়সী শিশুর পেশিতে যে শক্তি থাকা দরকার, তা ওর নেই। শিশুটি বংশগত রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগটির নাম স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ)।
তখন করোনা শেষ হয়নি, বিদেশ যাতায়াত কঠিন ছিল। আমরা অক্টোবরে (২০২১) ভারতের চেন্নাই গিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে মেয়েকে দেখাই। চেন্নাই থেকে রক্তের নমুনা পাঠানো হয় বেঙ্গালুরুতে। নভেম্বরে আমাদের জানানো হয় মেয়ের এসএমএ।শাহাদাৎ হোসেন, অলিভিয়া সঞ্চারী নবনীর বাবা
শাহিন আক্তার ও শাহাদাৎ হোসেন দম্পতির একমাত্র সন্তান এই শিশু। নাম অলিভিয়া সঞ্চারী নবনী, বয়স চার বছর দুই মাস। রাজধানীর মগবাজারে তাঁদের বাসা। সন্তানের এসএমএ আছে জানার মুহূর্ত থেকে এই দম্পতির কাছে দুনিয়ার সবকিছু যেন ধূসর হয়ে গেছে। তাঁদের মেয়ে বিরল রোগে ভুগছে। এমন রোগ কম দেখা যায়। এসএমএ একটি বিরল রোগ।
পারে না শুধু দাঁড়াতে, হাঁটতে। সোজা হয়ে বসতে পারে না। বসলে মাথা ঢলে পড়ে। এই বয়সী শিশুর পেশিতে যে শক্তি থাকা দরকার, তা ওর নেই। শিশুটি বংশগত রোগে আক্রান্ত। চিকিৎসাবিজ্ঞানে রোগটির নাম স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফি (এসএমএ)।
২৩ আগস্ট ওই দম্পতির বাসায় তাঁদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বাসা ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে কথা হয় শিশুটির সঙ্গে। শিশুর মা শাহিন আক্তার বলেন, ২০২১ সালের ২০ জুন নবনীর জন্ম। ঠিক সময়ে জন্ম হয়েছিল, জন্মের সময় ওজন ৩ কিলোগ্রামের বেশি ছিল। হাত–পা নড়াচড়াতেও সমস্যা ছিল না। জন্মের ২৫–২৬ দিন পর প্রথম চোখে পড়ল, মেয়ের পা দুটোর নড়াচড়া কমে গেছে। স্বামী–স্ত্রী মেয়েকে নিয়ে শিশু স্নায়ুরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মিজানুর রহমানের শরণাপন্ন হন। ওই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক একটি পরীক্ষা করানোর পরামর্শ দেন, যে পরীক্ষার ব্যবস্থা দেশে ছিল না।
শিশুর বাবা শাহাদাৎ হোসেন বলেন, ‘তখন করোনা শেষ হয়নি, বিদেশ যাতায়াত কঠিন ছিল। আমরা অক্টোবরে (২০২১) ভারতের চেন্নাই গিয়ে অ্যাপোলো হাসপাতালে মেয়েকে দেখাই। চেন্নাই থেকে রক্তের নমুনা পাঠানো হয় বেঙ্গালুরুতে। নভেম্বরে আমাদের জানানো হয় মেয়ের এসএমএ।’
চিকিৎসাবিজ্ঞান বলে এসএমএ মানুষের জিনের ত্রুটিজনিত রোগ। মা ও বাবা উভয়ই এসএমএর বাহক হলে তাঁদের সন্তানদের ২৫ শতাংশ ঝুঁকি থাকে এসএমএ রোগী হওয়ার। এসএমএ থাকলে পেশি নিয়ন্ত্রণের শক্তি ক্রমাগত কমতে থাকে, খাবার চিবানো ও গিলতে অসুবিধা হয়, মেরুদণ্ড বাকা ও কুঁজো হয়, শ্বাসকষ্ট থাকে। এসএমএর রোগীর দাঁড়াতে, হাঁটতে, সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। সাধারণত ১০ হাজার শিশু জন্মে একটি শিশুর এসএমএ দেখা যায়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসএমএ–কে আমরা বিরল রোগ বলছি। তবে দেশে আরও অনেক ধরনের বিরল রোগ আছে।’
বিরল রোগ সংক্রামক বা অসংক্রমাক হতে পারে। তবে বিরল রোগ কেন্দ্রে কেন্দ্রে রেখে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোনো ধরনের কাজ নেই। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিরল রোগ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথকভাবে কোনো শাখা নেই। সামগ্রিকভাবে বিরল রোগ নিয়ে কোনো কাজ নেই। বিশেষ কোনো বিরল রোগ নিয়ে আলোচনা উঠলে তখন সেটার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।’
এসএমএ–কে আমরা বিরল রোগ বলছি। তবে দেশে আরও অনেক ধরনের বিরল রোগ আছে।ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের পরিচালক অধ্যাপক কাজী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ
বিরল রোগ কী
জনগোষ্ঠীর মধ্যে যে রোগের প্রাদুর্ভাব কম দেখা যায়, তা বিরল রোগ। এ বছর ফেব্রুয়ারির বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি দলিল বলছে, বিরল রোগ হচ্ছে একটি বিশেষ স্বাস্থ্য পরিস্থিতি, যা প্রতি দুই হাজার মানুষের মধ্যে একজনে বা তার কমে দেখা দেয়। বিশ্বব্যাপী প্রায় সাত হাজার বিরল রোগ আছে, ভুগছে প্রায় ৩০ কোটি মানুষ। ৭০ শতাংশ বিরল রোগ শিশু বয়সে শুরু হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিরল রোগ সাধারণত জটিল, একাধিক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এতে প্রভাবিত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি সহ–অসুস্থতায় (কো–মরবিডিটি) ভোগে। রোগটি দ্রুত অবনতির দিকে যায়, প্রতিবন্ধিতা সৃষ্টি করে ও অকালমৃত্যুর কারণ হয়।
বিরল রোগ নিয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের অনেক দেশে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এদের নিয়ে কাজও কম। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে থাকতে দেখা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি দুই লাখ মানুষের মধ্যে একজনের যে রোগটি হয়, তা বিরল রোগ। দেশটিতে প্রায় ছয় হাজার বিরল রোগ আছে। এসব রোগে আড়াই কোটি মানুষ ভুগছে।
এসএমএ, ডিএমডি, হিমোফিলিয়া, মোয়ামোয়া, সিফা সিনড্রোম, রেটস সিনড্রোম, প্রজেরিয়া, ট্রি ম্যান সিনড্রোম, এক্সপির মতো বিরল রোগের কথা জানা গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
দেশে কত বিরল রোগ
এই প্রতিবেদক গত মার্চ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত তিনটি হাসপাতাল, বেশ কয়েকজন চিকিৎসক ও ৩০ জনের বেশি অভিভাববক ও রোগীর সঙ্গে কথা বলে দেশে বিরল রোগের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছেন। এই সময়ে এসএমএ, ডিএমডি, হিমোফিলিয়া, মোয়ামোয়া, সিফা সিনড্রোম, রেটস সিনড্রোম, প্রজেরিয়া, ট্রি ম্যান সিনড্রোম, এক্সপির মতো বিরল রোগের কথা জানা গেছে। প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
এসএমএ জিনের ত্রুটিজনিত রোগ। এতে পেশির নিয়ন্ত্রণ শক্তি ক্রমাগত কমতে থাকে, খাবার চিবোতে ও গিলতে সমস্যা হয়, মেরুদণ্ড বাঁকা ও কুঁজো হয়, শ্বাসকষ্ট থাকে। রোগীর দাঁড়াতে, হাঁটতে ও সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হয়। সাধারণত ১০ হাজার শিশু জন্ম নিলে তাদের মধ্যে একজনের এই রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে। দেশে এই রোগী আছে ২০০ থেকে ৩০০।
জিনের ত্রুটিজনিত আরেকটি রোগ ডুচেনি মাসকুলার ডিস্ট্রোফি (ডিএমডি)। এটি ছেলেদের বেশি হয়। ১০ থেকে ১২ বছর বয়সে পায়ের পেশি শক্ত হয়ে যায়। অনুমান করা হয়, দেশে ডিএমডি রোগী আছে দুই শর কাছাকাছি। ১০ হাজার জীবিত জন্মে একজনের এটি দেখা যায়।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের চিকিৎসকেরা ‘রেটস সিনড্রোম’ নামের একটি বিরল রোগ নিয়ে গবেষণা করছেন। এটিও জিনের ত্রুটিজনিত স্নায়ুর রোগ। জন্মের দেড়-দুই বছর পর্যন্ত শিশু ভালোই থাকে। তারপর থেকে শিশুর খিঁচুনি হতে দেখা যায়। শিশুর মাথা বড় হয় না। শিশু ভুলে যেতে থাকে। কত মানুষ এতে আক্রান্ত, তা জানা যায় না।
দেশের গণমাধ্যমগুলো ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ‘বৃক্ষমানব’ আবুল বাজনদারকে নিয়ে অনেক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে থাকে। আবুল বাজনদারের হাত ও পায়ের আকৃতি ছিল গাছের শিকড়ের মতো। জিনের নির্দিষ্ট ত্রুটি থাকা মানুষ হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসে আক্রান্ত হলে রোগটি দেখা দেয়।
আবুল বাজনদার ১৯ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদককে বলেন, তিনি আবার অস্ত্রোপচারের জন্য জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হয়েছেন। এ পর্যন্ত তাঁর দুই হাত ও দুই পায়ে ৩০টি বড় অস্ত্রোপচার হয়েছে।
প্রায় একইভাবে গণমাধ্যমের দৃষ্টি পড়েছিল একজন ‘প্রজেরিয়া’ রোগীর ওপর। এতে শিশুর চেহারা প্রবীণের মতো হয়। জিনের রূপান্তরে এটা হয়। মানুষ অল্প সময়ে বুড়িয়ে যায়। হৃদ্রোগ ও রক্তনালির রোগের ঝুঁকি থাকে। এক কোটি মানুষের মধ্যে এমন ব্যক্তি একজন দেখা যায়।
রক্তের একটি বিরল রোগ হিমোফিলিয়া। কেটে গেলে রক্তপাত বন্ধ হয় না। এই রোগ সাধারণত পুরুষের হয়, নারী এই রোগের বাহক। ১০ হাজার মানুষের মধ্যে এই রোগে একজনকে আক্রান্ত হতে দেখা যায়।
২০১৬ সালের নভেম্বরে রাজধানীর উত্তরার একটি প্রায় অন্ধকার ঘরে ৮ ও ১২ বছর বয়সী দুই ভাইবোনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। এরা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না। দুই ভাইবোন জিনের ত্রুটিজনিত জেরোডার্মা পিগমেনটোসামের (এক্সপি) রোগী। এক্সপির রোগী আলোতে থাকলে কয়েক মিনিটের মধ্যে চামড়া শুকিয়ে যায়। তাদের স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যা দেখা দেয়, শ্রবণশক্তি কমে যায়। তাদের এখনো চিকিৎসা চলছে।
দেশে অন্তত ২০০ জন ‘মোয়ামোয়া’ রোগী আছে। এটি মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ। এতে মস্তিষ্কের ধমনিতে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। রোগীর সাময়িকভাবে তীব্র মাথাব্যথা, শরীরের একাংশে অবশ ভাব, খিঁচুনি, কথায় অস্পষ্টতা, চোখে ঝাপসা দেখা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া—এই রোগের লক্ষণ।
বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের গবেষকেরা জানিয়েছেন, দেশে অন্তত ২০০ জন ‘মোয়ামোয়া’ রোগী আছে। এটি মস্তিষ্কের রক্তনালির রোগ। এতে মস্তিষ্কের ধমনিতে রক্ত সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়। রোগীর সাময়িকভাবে তীব্র মাথাব্যথা, শরীরের একাংশে অবশ ভাব, খিঁচুনি, কথায় অস্পষ্টতা, চোখে ঝাপসা দেখা, স্মরণশক্তি কমে যাওয়া—এই রোগের লক্ষণ।
দেশে স্নায়ুর বিরল রোগ আছে অন্তত ১৫টি। অন্য কতটি বিরল রোগের অস্তিত্ব আছে, তা জানা নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, খোঁজা হয়নি।ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক (শিশু নিউরোলজি বিভাগ) জুবাইদা পারভীন
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া জানান, তিনি ময়মনসিংহের একটি পরিবারে ‘সিফা সিনড্রোম’ (কনজেনিটাল ইনসেনসিভিটি টু পেইন উইথ অ্যানহিড্রোসিস)–এর দুজন রোগী পেয়েছেন। ঘর্মগ্রন্থি (সোয়েট গ্লান্ড) না থাকার কারণে এদের ঘাম হয় না। এদের গরম লাগে বেশি, হিটস্ট্রোকের ঝুঁকি বেশি। এরা ব্যথা অনুভব করে না।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক (শিশু নিউরোলজি বিভাগ) জুবাইদা পারভীন বলেন, ‘দেশে স্নায়ুর বিরল রোগ আছে অন্তত ১৫টি। অন্য কতটি বিরল রোগের অস্তিত্ব আছে, তা জানা নেই। প্রকৃত সত্য হচ্ছে, খোঁজা হয়নি।’
অবিরাম কষ্টের কাহিনি
রাজধানীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা মোহাম্মদ পারভেজের প্রথম সন্তান মুনতাসিরের জন্ম হয় ২০১৪ সালে। জন্মের পাঁচ বছর পর মুনতাসিরের অস্বাভাবিকতা চোখে পড়ে। সে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারে না, পা বেঁকে যায়, পায়ের পেশিতে ব্যথার কথা বলতে থাকে। ২০২২ সালে শনাক্ত হয় মুনতাসির ডিএমডির রোগী।
ডিএমডির রোগীর বয়স বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাত–পায়ের পেশি শক্ত হয়ে যায়, আঙুল বেঁকে যায়। আক্রান্ত শিশুর বয়স ১০–১২ হতেই নিজ থেকে আর চলাচল করতে পারে না। বাবা–মায়ের সামর্থ্য থাকলে হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে পারে। মুনতাসিরের ক্ষেত্রে ঠিক এমনই হয়েছে।
১৫ এপ্রিল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে মুনতাসিরের বাবা মোহাম্মদ পারভেজের সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, ‘কিছুই করতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে ছেলেটি ধীরে ধীরে অচল হয়ে গেল। বয়স মাত্র ১১ বছর। কিছুই করতে পারলাম না।’ চিকিৎসকেরা সতর্ক করে বলেছেন, এমন শিশুরা বেশি দিন বাঁচে না।
সন্তানের গল্প বলতে গিয়ে মায়ের চোখ ভেসে যায় জলে। কারও কষ্ট চিকিৎসা করাতে না পারার। কেউ জানেন চিকিৎসা করিয়েও সন্তানকে বাঁচাতে পারবেন না। ‘আমি মারা গেলে আমার সন্তানের কী হবে’, এমন চিন্তায় দিন যায় কোনো কোনো মায়ের।
মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের বিরল রোগে আক্রান্ত মানুষ, তাদের বাবা–মা–অভিভাবসহ অন্তত ৩০ জনের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়। তাঁদের সবাই মোহাম্মদ পারভেজের মতো অসহায়। সন্তানের গল্প বলতে গিয়ে মায়ের চোখ ভেসে যায় জলে। কারও কষ্ট চিকিৎসা করাতে না পারার। কেউ জানেন চিকিৎসা করিয়েও সন্তানকে বাঁচাতে পারবেন না। ‘আমি মারা গেলে আমার সন্তানের কী হবে’, এমন চিন্তায় দিন যায় কোনো কোনো মায়ের।
কিছুই করতে পারলাম না। আমার চোখের সামনে ছেলেটি ধীরে ধীরে অচল হয়ে গেল। বয়স মাত্র ১১ বছর। কিছুই করতে পারলাম না।ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে মুনতাসিরের বাবা মোহাম্মদ পারভেজ
২০ মার্চ কথা হয় খুলনার লবণচরার নূরজাহান রজনী ও মেহেদি হাসান আমিরের সঙ্গে। নূরজাহান রজনী কৃষি ব্যাংকে চাকরি করেন, মেহেদি হাসান আমির এলাকায় ছোটখাটো ঠিকাদারির কাজ করেন। তাঁদের তৃতীয় সন্তান আমিরা এসএমএর রোগী। আমিরা প্রায়ই তার বাবা–মা ও দুই বোনের উদ্দেশে বলে, ‘রাগ কোরো না। আমি বসতে পারি না, আমি হাঁটতে পারি না, রাগ কোরো না।’ নূরজাহান রজনী প্রথম আলোকে বলেন, ‘এতটুকু মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে বুক ফেটে কান্না আসে।’
এমন সন্তান নিয়ে মা–বাবার জীবন আমূল বদলে যায়। রাজধানীর মগবাজারের শাহিন আক্তার ও শাহাদাৎ হোসেন দম্পতির ক্ষেত্রে তেমনই ঘটেছে। দুজন একসময় একটি বামপন্থী সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিয়মিত ওই দলের অনুষ্ঠানে যোগ দিতেন, অংশ নিতেন। এখন সব বন্ধ। শাহাদাৎ হোসেন চাকরির প্রয়োজনে কর্মস্থলে যান। আপনার সময় কাটে কীভাবে? এমন প্রশ্নের উত্তরে মা শাহিন আক্তার বলেন, ‘আমার নিজের বলে আর কোনো সময় নেই। সারাটা সময় মেয়ের সঙ্গে। মেয়ে যখন ঘুমায়, তখনই কিছুটা ছুটি।’ ঘরের বাইরে যাওয়া নেই, আত্মীয় বাড়ি যাওয়া নেই। সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া বন্ধ। শাহিন আক্তারের দুনিয়া আটকে গেছে মেয়েতে।
রাগ কোরো না। আমি বসতে পারি না, আমি হাঁটতে পারি না, রাগ কোরো না।আমিরা, এসএমএর রোগী
এমন সন্তান দুটো থাকলে সমস্যা কি বেড়ে যায়? দুঃখ কি দ্বিগুণ হয়? ব্যবসায়ী ওমর ফারুকের দুটি ছেলেই বিরল রোগে আক্রান্ত। ২৩–২৪ আগস্ট ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালে আয়োজিত একটি ওয়ার্কশপের প্রথম দিনের একটি অধিবেশনে ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের জীবন বদলে গেছে। আমাদের জীবন থেকে আনন্দ হারিয়ে গেছে।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অভিভাবক বলেন, এমন বাবা–মাও আছেন, যাঁদের তিনটি সন্তানই বিরল রোগে ভুগছে। ঘরজুড়ে একটি খাট, তার ওপর তিন সন্তানকে নিয়ে স্বামী–স্ত্রী রাত কাটাতেন। ইতিমধ্যে একটি সন্তান মারা গেছে। এখন ওই খাটেই বাবা–মা রাত কাটান বাকি দুই সন্তানকে নিয়ে।
সহজে রোগ শনাক্ত হয় না
পুরান ঢাকার সুজন সাহা ও রমা সাহার একমাত্র মেয়ে স্বস্তিকা সাহা। মেয়ের বয়স যখন ৯ মাস, বাবা–মা খেয়াল করলেন, মেয়ের বসতে ও দাঁড়াতে কষ্ট হয়। সুজন সাহা বলেন, ‘প্রথম মেয়েকে মিটফোর্ড হাসপাতালে দেখাই। পরে পিজি হাসপাতালে দেখাই। তারপর পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। মেয়ে দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। আট মাস আগে ভারতের চেন্নাই গেলাম। পরীক্ষায় ধরা পড়ল মেয়ের এসএমএ। আগের তিনটি হাসপাতালের কোনো চিকিৎসকই রোগ ধরতে পারেননি।’ একাধিক শিশুর মা-বাবার কাছ থেকে একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা শোনা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন আফরিন আক্তার। তিনি এসএমএর রোগী। তিনি বলেন, প্রথমে একজন চিকিৎসক মায়োপ্যাথির চিকিৎসা দেন। পরে দেশে-বিদেশে পরীক্ষায় নিশ্চিত হন যে তার এসএমএ। আফরিন আক্তার বলেন, ‘তিন বছরের বেশি সময় আমি ভুল চিকিৎসার মধ্যে ছিলাম।’ তিনি এখন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন।
প্রায় সব বিরল রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই বলে জানিয়েছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ অধ্যাপক মো. টিটো মিয়া। তিনি বলেন, ‘আমরা কিছু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট দিই, যেন রোগী স্বস্তি বোধ করে, রোগটি যেন আর না বাড়ে।’
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের শিশু নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাওলী সরকার বলেন, ‘রোগনির্ণয় সঠিক না হলে ভুল চিকিৎসা হয়। এক রোগের লক্ষণ কিছু ক্ষেত্রে অন্য রোগের সঙ্গে মিলে যায়, তখন ভুল চিকিৎসার ঝুঁকি তৈরি হয়। কোনো রোগের চিকিৎসাই হয়তো জানা নেই, তখন রোগটি যেন না বাড়ে, সে জন্য কিছু চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ভালো রেফারেল পদ্ধতি না থাকার কারণে রোগীরা ভুল প্রতিষ্ঠান বা ভুল ব্যক্তির কাছে চলে যান, এতে সঠিক চিকিৎসা রোগীরা পান না।’
প্রথম মেয়েকে মিটফোর্ড হাসপাতালে দেখাই। পরে পিজি হাসপাতালে দেখাই। তারপর পান্থপথের একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েছিলাম। মেয়ে দিন দিন দুর্বল হতে থাকে। আট মাস আগে ভারতের চেন্নাই গেলাম। পরীক্ষায় ধরা পড়ল মেয়ের এসএমএ। আগের তিনটি হাসপাতালের কোনো চিকিৎসকই রোগ ধরতে পারেননি।স্বস্তিকা সাহা, সুজন সাহা ও রমা সাহার একমাত্র মেয়ে
৯৫ শতাংশের চিকিৎসা নেই
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিরল রোগের চিকিৎসা–সম্পর্কিত ওষুধসহ অন্যান্য পণ্যের দাম অনেক বেশি। অনেক দেশে এসব পণ্য ও ওষুধের প্রবেশাধিকার সীমিত। এটি বড় চ্যালেঞ্জ।
যেমন স্পাইনাল মাসকুলার অ্যাট্রোফির (এসএমএ) কথা বলা যায়। চিকিৎসক ও ওষুধ কোম্পানি সূত্রে জানা গেছে, এ রোগের চিকিৎসার ওষুধ তিনটি। প্রথমত জিনথেরাপি। ইনজেকশনের মাধ্যমে জীবনে তা একবারই দিতে হয়। এর দাম প্রায় ২২ কোটি টাকা। আরেকটি ইনজেকশন আছে, প্রতি দুই মাস অন্তর রোগীর মেরুদণ্ডে দিতে হয়। একটি ইনজেকশনের দাম এক কোটি টাকা। আর আছে একটি সিরাপ। এর প্রতি বোতলের দাম ১০ লাখ টাকা। একজন রোগীর মাসে এক বোতল দরকার হয়।
জিনথেরাপি বাংলাদেশে দুটি শিশুকে দেওয়া হয়েছে। মেরুদণ্ডে দেওয়া ইনজেকশন কেউ পেয়েছে বলে জানা যায়নি। একটি বহুজাতিক কোম্পানি দেশের তিনটি শিশুকে বিনা মূল্যে সিরাপ দেওয়া শুরু করে। এখন শুধু মগবাজারের নবনী ওষুধটি বিনা মূল্যে পাচ্ছে।
বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করে ওষুধ উদ্ভাবন করে তা সীমিতসংখ্যক মানুষের কাছে বিক্রি করা ওষুধ কোম্পানির জন্য লাভজনক নয়। যে দু–একটি ওষুধ তৈরি হয়, তার দাম বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওষুধ উদ্ভাবনে সমতাভিত্তিক বিনিয়োগ ও আর্থিক প্রণোদনার অভাবের কারণে সারা বিশ্বের ৯৫ শতাংশ বিরল রোগের এখনো কার্যকর চিকিৎসা নেই।
বিরল রোগ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথক শাখা নেই। সামগ্রিকভাবে বিরল রোগ নিয়ে কাজও নেই। বিশেষ কোনো বিরল রোগ নিয়ে আলোচনা উঠলে তখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর
রাষ্ট্র কী করছে
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিরল রোগ নিয়ে তাদের কোনো ধরনের কাজ নেই।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবু জাফর বলেন, ‘বিরল রোগ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পৃথক শাখা নেই। সামগ্রিকভাবে বিরল রোগ নিয়ে কাজও নেই। বিশেষ কোনো বিরল রোগ নিয়ে আলোচনা উঠলে তখন প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’
ব্যতিক্রমী ভূমিকা নিয়েছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটাল, বিশেষ করে এই প্রতিষ্ঠানের শিশু নিউরো বিভাগ। এই বিভাগ বিরল রোগে আক্রান্ত শিশুদের জন্য প্রতি সপ্তাহে বিশেষ ক্লিনিক চালু করেছে। এ ছাড়া প্রতি মাসের মাঝামাঝি এক দিন বড় করে নিয়মিত সেমিনারের আয়োজন করে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরে একটি বিরল রোগের (এসএমএ) চিকিৎসা ও শল্যচিকিৎসার সরঞ্জাম কেনার জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের অনুকূলে ৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক কাজী গিয়াস উদ্দিন আহমেদ বলেন, ৫ কোটি টাকার ওষুধ কেনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বাকি টাকা খরচ করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।
এই ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। রোগ শনাক্তে উপযুক্ত ল্যাবরেটরি স্থাপন করা জরুরি।ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক জুবাইদা পারভীন
আত্মশক্তির সন্ধান
বিরল রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিদের সহায়তা বা পাশে দাঁড়ানোর জন্য কয়েকটি সংগঠন গড়ে উঠেছে। এসব সংগঠন তথ্য সংগ্রহ করে, দেশে–বিদেশে কোথায় রোগ পরীক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে, তা জানার ও জানানোর চেষ্টা করে।
এমনই একটি সংগঠন কিওর এসএমএ বাংলাদেশ। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক বলেন, ‘এসএমএ রোগী ও তাদের অভিভাবকদের নিয়ে এই সংগঠন তৈরি হয়েছে। রোগটির ব্যাপারে সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি রোগনির্ণয়ে জেনেটিক পরীক্ষা দেশে চালু করার জন্য আমরা দৌড়ঝাঁপ করছি। ওষুধ কোম্পানি ও চিকিৎসকদের সঙ্গে নিয়ে আমরা চেষ্টা করছি যেন কম দামে ওষুধ পাওয়া যায়।’
একইভাবে ডিএমডি রোগীদের জন্য গড়ে ওঠা সংগঠনের নাম ডিএমডি কেয়ার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। হিমোফিলিয়া রোগীদেরও আছে বাংলাদেশ হিমোফিলিয়া সোসাইটি। এই ধরনের সংগঠন বিদেশে আছে।
কী করা যায়
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, আক্রান্ত ব্যক্তিদের প্রয়োজন অনুযায়ী একটি সার্বিক ও রোগীকেন্দ্রিক পন্থা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ব্যক্তির সক্ষমতা উন্নয়নে সহায়তা দেওয়া, সামাজিকভাবে তাদের সম্পৃক্ত রাখার পাশাপাশি স্বাস্থ্য, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানে প্রবেশের বাধা দূর করা জরুরি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে বিরল রোগের জন্য পৃথক শাখা খোলার দাবি করেছেন কেউ, কেউ সচেতনতা বাড়ানোর ওপর জোর দিয়েছেন। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার কথাও কেউ কেউ বলেন।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সেস অ্যান্ড হসপিটালের সহকারী অধ্যাপক জুবাইদা পারভীন বলেন, ‘এই ক্ষেত্রে দক্ষ জনবল গড়ে তুলতে হবে। রোগ শনাক্তে উপযুক্ত ল্যাবরেটরি স্থাপন করা জরুরি।’
[প্রথম আলো রোগী ও রোগীর অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে তাঁদের নাম এই প্রতিবেদনে প্রকাশ করেছে।]