‘মেয়ে শুধু বলে, বাবা ভয় লাগতেছে’

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসাধীন আছেন মেয়েটিছবি: প্রথম আলো

মেয়েটিকে ধর্ষণের পর ঘরের মেঝে রক্তে ভেসে যাচ্ছিল। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাঁর অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছিল যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ভর্তির পর ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েটির জবানবন্দি নিয়ে রেখেছিলেন। ভুক্তভোগী ওই তরুণী প্রাণে বেঁচে গেলেও তাঁকে দীর্ঘ মেয়াদে শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি পোহাতে হবে।

আজ মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে মেয়েটির বাবা ও মায়ের সঙ্গে কথা হয়। বাবা বললেন, ‘আমার মেয়েটিকে নির্যাতন করা হইছে। মেয়ে যে বাঁচব তা–ই তো বিশ্বাস করতে পারতেছিলাম না। ছয় ব্যাগ রক্ত দিতে হইছে। এখন একলা হাঁটতেও পারে না। কবে সুস্থ হইব তা–ও জানি না। আইসিইউতে গেলেই মেয়ে শুধু বলে, বাবা ভয় লাগতেছে।’

গত ২৪ এপ্রিল দুপুরে আশুলিয়ায় নিজের বাড়িতে ধর্ষণের শিকার হন মেয়েটি। স্থানীয় হাসপাতাল হয়ে সেদিনই রাত একটার দিকে তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ধর্ষণে মেয়েটির প্রজনন অঙ্গ ছিঁড়ে যাওয়ায় অস্ত্রোপচার করতে হয়। অস্ত্রোপচারের পর রক্তচাপ কমে যাওয়াসহ নানা জটিলতায় পোশাককর্মী মেয়েটিকে হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করতে হয়।

ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বাবা দিনমজুর। কাজ করলে কোনো দিন ৫০০ টাকা আবার কোনো দিন ৬০০ টাকা মজুরি পান। মেয়েটির মা স্থানীয় একটি হাসপাতালে আট হাজার টাকায় আয়ার কাজ করেন। আর মেয়েটি আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় হেলপার হিসেবে কাজ করে মাসে ১২ হাজার টাকা এবং ওভারটাইম করলে আর কিছু বেশি টাকা পেতেন। তাঁকে ধর্ষণে অভিযুক্ত ব্যক্তি মেয়েটির সঙ্গে একই পোশাক কারখানায় অপারেটর হিসেবে কাজ করতেন।

ভুক্তভোগী মেয়েটির বাবা জানান, ধর্ষকের বয়স ৩৫ বছর, বিয়ে করেছেন, ছেলেমেয়ে আছে। তিনি কারখানায় অনেক দিন ধরেই তাঁর মেয়েকে নানাভাবে হয়রানি করতেন। তাঁর কথামতো কাজ না করলে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা হবে বলেও হুমকি দিচ্ছিলেন। ঘটনার দিন সকালেই মেয়েকে ফোন করে জানতে চেয়েছিলেন বাসায় কে কে আছে? সকালে সবাই যাঁর যাঁর কাজে বের হয়ে গিয়েছেন, এ তথ্যও তাঁকে জানিয়ে দিয়েছিলেন ওই তরুণী। দুপুরে খাওয়ার সময় মেয়েটি বাসায় আসেন। সে সময় ওই ব্যক্তি দরজায় ধাক্কা দিলে মেয়েটি দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দেন। মেয়েটি চিৎকার করতে চাইলে মুখে হাতচাপা দিয়ে তাঁকে ধর্ষণ করেন। এসব তথ্য মেয়েটি জ্ঞান ফেরার পর তাঁর মা–বাবাকে জানিয়েছেন।

ধর্ষণের শিকার হওয়ার পর মেয়েটি শুধু তাঁর মাকে ফোন করে বলতে পেরেছিলেন, তিনি মারা যাচ্ছেন। মা বাড়ি এসে দেখেন, মেয়েটি ঘরের মেঝেতে রক্তে ভেসে যাচ্ছেন। মুখ দিয়ে গোঙানির মতো শব্দ হচ্ছে। পরে মেয়েটি অজ্ঞান হয়ে পড়েন। বাবা এ খবর পেয়ে বাড়ি ফিরে মেয়েটিকে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেন। হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানান, মেয়েটি ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ওই হাসপাতালের চিকিৎসকেরা প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে মেয়েটিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

এই বাবা জানান, ওই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই আড়াই হাজার টাকায় একটি অ্যাম্বুলেন্স ঠিক করে দিয়েছিল। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) নিলে সেখানে দায়িত্বরত ব্যক্তিরা আশুলিয়া থানায় ফোন করে সব তথ্য জানিয়ে মামলা নিতে বলেন। এর মধ্যেই মেয়েটিকে বাঁচানোর জন্য চিকিৎসকেরা চিকিৎসা শুরু করেন।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের (চতুর্থ পর্ব) অধীন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুদের সমন্বিত সেবা দেওয়ার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ওসিসি চিকিৎসা ও আইনি সেবা দিচ্ছে। ওসিসির সমন্বয়কারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, অস্ত্রোপচারের পর মেয়েটির রক্তচাপের সমস্যাসহ নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাঁর রক্তে হিমোগ্লোবিন কমে গিয়েছিল। ওসিসির শৌচাগারে গিয়ে মেয়েটি মাথা ঘুরে পড়ে যান। তখনই তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালকের সহায়তায় দ্রুত আইসিইউতে ভর্তি করা হয়।

চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘মেয়েটির শারীরিক অবস্থা খুব খারাপ ছিল। শকে চলে গেলে দ্রুত আইসিইউতে নেওয়া হয়। মেয়েটি বাঁচবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। ওসিসির পক্ষ থেকে ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে আইসিইউতেই মেয়েটির ডাইং ডিক্লারেশন বা মৃত্যুপূর্ব জবানবন্দি নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। তবে এখন তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আইসিইউ থেকে মেয়েটিকে ওসিসিতে আনার প্রক্রিয়া চলছে।’

মেয়েটির বাবা জানান, এই ঘটনার পর থেকে মেয়ের সঙ্গে মেয়ের মা এবং তাঁর কাজ বন্ধ। মেয়ে আইসিইউতে আর তাঁরা আইসিইউর দরজার সামনে দিনরাত পার করছেন।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউর সামনে পাটি বিছিয়ে মেয়েটির পরিবার সেখানেই থাকছে। পরিবারের উপার্জনক্ষম তিনজনের কাজ বন্ধ থাকায় আর্থিক অনটনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চেনা–পরিচিতদের কাছ থেকে ধারদেনা করতে হয়েছে। হাসপাতাল থেকেও আর্থিক সহায়তার আশ্বাস পেয়েছেন। মেয়েটির বাবা ও মা ধর্ষকের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের চাওয়া, ধর্ষক এমন শাস্তি পাক, যা দেখে অন্যরা আর এ ধরনের কাজ করার সাহস না পান।

মেয়ের বয়স কত তা বাবা সঠিকভাবে বলতে না পারলেও হাসপাতালের কাগজে-কলমে তাঁর বয়স ১৯ বছর লেখা আছে। দুই বছর আগে অভাব অনটনের জন্যই মেয়েটির পরিবার রাজশাহী থেকে আশুলিয়ায় এসেছিল। তখন থেকেই মেয়েটি পোশাক কারখানায় কাজ করছিলেন। তাঁর এক বোন গ্রামের এক কলেজে বিএ পড়ছেন। এক ভাই চট্টগ্রামে ও আরেক ছোট বোন আশুলিয়ায় এক মাদ্রাসায় পড়ছে।

মেয়েটির বাবা জানান, তাঁর এই মেয়ে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে। সংসারের অভাব অনটনের কারণে এরপর তিন কাজ শুরু করেন। বাবা, মায়ের পাশাপাশি মেয়েটির রোজগারের টাকাতেই সংসার খরচ ও অন্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ চলছিল। মেয়ে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে কবে নাগাদ কাজ করতে পারে, তা এখন অনিশ্চিত।

২৪ এপ্রিল রাতেই মেয়েটির বাবা আশুলিয়া থানায় মামলা করেন। তিনি জানান, মামলা করার পর আসামির পক্ষ থেকে বিভিন্ন জন ফোন করে মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি দিচ্ছেন।

এ মামলাটি তদন্ত করছেন আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নূর মোহাম্মদ খান। মুঠোফোনে তিনি জানান, ২৫ এপ্রিল আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিকে দুই দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়। আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন। আসামি ধর্ষণের কথা শিকার করেছেন এবং প্রাথমিক তদন্তেও ধর্ষণের আলামত পাওয়া গেছে।

আইসিইউতে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে মেয়েটি যখন ‘ডাইং ডিক্লারেশন’ দেন, সে সময় নূর মোহাম্মদ খান সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান, মেয়েটি জানিয়েছেন, ধর্ষণের পর তিনি অসুস্থ হয়ে পড়লে আসামি পালিয়ে যান। তবে যাওয়ার আগে এ ঘটনা তিনি যাতে কাউকে না বলেন এবং চুপ থাকেন সে বিষয়ে শাসিয়ে গেছেন। সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে ব্যথা পাওয়ায় রক্তপাত হয়েছে বলেও মেয়েটিকে বলতে বলেন।

পুলিশ কর্মকর্তা নূর মোহাম্মদ খান বলেন, কোনো ঘটনায় কেউ মারা যেতে পারেন, এমন অবস্থা হলে সাক্ষ্যপ্রমাণের জন্য ডাইং ডিক্লারেশন নেওয়া হয়। ধর্ষণের শিকার মেয়েটির অবস্থা এতই খারাপ হয়েছিল যে মামলার প্রয়োজনে এ জবানবন্দি নিয়ে রাখা হয়েছিল।