আগামী নির্বাচনে পুলিশের ৬ চ্যালেঞ্জ 

দলীয় চাপ, সক্ষমতা, সীমিত জনবল, সাইবার হুমকি, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও আ.লীগের নেতা-কর্মীদের মোকাবিলায় বিশেষ প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ।

প্রতীকী ছবি

রাজনৈতিক দলের চাপ, সক্ষমতা, সীমিত জনবল, সাইবার হুমকি, লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার ও কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মোকাবিলা—আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এই ছয়টি বিষয়কে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছে পুলিশ। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে প্রস্তুতি শুরু করেছে পুলিশ।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় সব নির্বাচন নিয়ে সমালোচনা রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসনের নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের বেশির ভাগ মানুষ নির্বাচনবিমুখ হয়ে পড়েন। এবার যাতে উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়, সে জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে পুলিশের পক্ষ থেকে। ২০১৮ ও ২০২৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারী বেশির ভাগ পুলিশ সুপারকে ইতিমধ্যে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, আগামী নির্বাচনে পুলিশ সদস্যরা যাতে কোনো দলের পক্ষে অবস্থান না নিয়ে পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করেন, তা নিশ্চিত করতে দেড় লাখ পুলিশ সদস্যকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পুলিশের কনস্টেবল থেকে উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আচরণবিধি, ভোটারের অধিকার, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা, আইন অনুযায়ী পুলিশের দায়িত্ব, নির্বাচনের আগে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ, নির্বাচনী সামগ্রী, ভোটকেন্দ্র ও বুথের নিরাপত্তা, মক নির্বাচন, নির্বাচনী সহিংসতা দমন ও নির্বাচন–পরবর্তী ব্যবস্থাপনা নিয়ে পুলিশ সদস্যরা প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। পাশাপাশি মনোবল চাঙা রাখতে নানা ধরনের ‘মোটিভেশন’ দেওয়া হচ্ছে।

আগামী নির্বাচনে পুলিশ যাতে কোনো অপেশাদার কাজ না করে, সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সে জন্যই এবার পুলিশ সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে
আবু নাসের মোহাম্মদ খালেদ, অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক

তবে প্রশিক্ষণরত একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর বড় ভূমিকা রয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন যতই প্রস্তুতি নিক, রাজনৈতিক দলগুলো না চাইলে দেশে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়।

পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, রাজনৈতিক দলের চাপ মোকাবিলার ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতা বজায় রেখে আইন প্রয়োগের জন্য পুলিশ সদস্যদের প্রস্তুত করা হচ্ছে। সক্ষমতা বাড়াতে কৌশলগত নানা প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। নির্বাচনে দায়িত্ব পালনকারীদের মধ্যে মাত্র ৯ থেকে ১০ শতাংশ পুলিশ। সীমিত জনবলের সংকট কাটাতে তাই স্থানীয় প্রশাসন ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। এ ছাড়া ভুয়া খবর ছড়িয়ে পরিস্থিতি উত্তপ্ত করা, পুরোনো ছবি ও ভিডিও ছড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোসহ সাইবার হুমকি মোকাবিলায় ফরেনসিক দল গঠন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করতে চেষ্টা করবেন, সেটা মোকাবিলায় নির্বাচনের আগে গ্রেপ্তার অভিযান আরও জোরদার করা হবে। বিদেশে পালিয়ে থাকা নেতা-কর্মীদের তৎপরতার ওপরও নজরদারি করা হবে।

আগামী নির্বাচনে সম্ভাব্য সহিংসতা মোকাবিলায় পুলিশের উদ্বেগের একটা বড় কারণ হচ্ছে থানা ও ফাঁড়ি থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার না হওয়া। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ১ হাজার ৩৫০টি অস্ত্র উদ্ধার হয়নি। নির্বাচনী সহিংসতায় এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, এসব অস্ত্রের কিছু বিচ্ছিন্নতাবাদীদের কাছে যেতে পারে, কিছু পাহাড়ি কিংবা আরসার হাতে যেতে পারে। তাই নির্বাচনের আগে এসব অস্ত্র উদ্ধারে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।

সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরের এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, আগামী নির্বাচনে পুলিশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা অর্জন ও ফ্যাসিস্টদের মোকাবিলা করা। তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর পুলিশ যে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসাটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা চাই অন্তত নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ আর উৎসবমুখর পরিবেশ তৈরি করতে। আমাদের যে সক্ষমতা রয়েছে, তা দিয়ে আমরা সেখানে পৌঁছাতে পারব বলে বিশ্বাস করি। এ চ্যালেঞ্জগুলো নিয়েই সামনে এগোব, সফল হব।’

সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য সংগ্রহ ও ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা 

সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন আসনের সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্য যাচাই-বাছাই শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশ সদর দপ্তর চিঠি পাঠিয়ে থানা এলাকার সম্ভাব্য প্রার্থীদের তথ্যাবলি ‘ছক’ আকারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে। এতে প্রার্থীর দলীয় পদ-পদবি, পিসি/পিআর (অতীত অপরাধ ও পুলিশ রেকর্ড), শিক্ষাগত যোগ্যতাসহ ১১ ধরনের তথ্য চাওয়া হয়েছে। মাঠপর্যায়ের তথ্যের ভিত্তিতে ঝুঁকিপূর্ণ নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনের সময় অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন, কোথায় মোবাইল টিম কিংবা র‌্যাব-পুলিশের টহল জোরদার করতে হবে, তা নির্ধারণ করা হবে।

এসব তথ্য সংগ্রহ করে ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিভিন্ন থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা (ওসি)। তাঁরা বলেন, পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে দুই সপ্তাহ আগে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

জাতীয় নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ও প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক আবু নাসের মোহাম্মদ খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের আগে আরও নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ আসবে। সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে একটা উৎসবমুখর নির্বাচন উপহার দিতে চাই। আগামী নির্বাচনে পুলিশ যাতে কোনো অপেশাদার কাজ না করে, সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই। সে জন্যই এবার পুলিশ সদস্যদের নির্বাচনী প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে।’