চিকিৎসায় ব্যবহৃত গজে ক্ষতিকর বস্তু

  • গজ তৈরি হতে হবে ১০০ শতাংশ কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে। নমুনা পরীক্ষায় কোনো গজে তা পাওয়া যায়নি। 

  • দেশে তৈরি গজে রেডিওলজিক্যাল মার্কার থাকে না।

  • কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে তৈরি গজের দাম কিছু বেশি।

সাতক্ষীরা মাঘুরালী গ্রামের একটি তাঁতঘর। এ রকম অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে তৈরি হয় চিকিৎসায় ব্যবহৃত গজ ব্যান্ডেজছবি: প্রথম আলো

মাঘুরালী গ্রামে সকালের শান্ত পরিবেশ নেই বললেই চলে। কানে আসে খটখট শব্দ। গ্রামের রাস্তার দুই পাশের ছোট ছোট বাড়ি থেকে এই শব্দ অবিরত আসতে থাকে। এ শব্দ বৈদ্যুতিক তাঁতের। তাঁতে বোনা হয় থান কাপড়। এ থেকে তৈরি হয় রোগীর চিকিৎসায় ব্যবহৃত গজ ব্যান্ডেজ। পরীক্ষাগারে নমুনা পরীক্ষায় এই গজে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বস্তু পাওয়া গেছে।

দক্ষিণের জেলা সাতক্ষীরার সুন্দরবন-সংলগ্ন উপজেলা কালীগঞ্জের একটি গ্রাম মাঘুরালী। এ গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাঁত আছে। শুধু মাঘুরালী নয়, আশপাশের নলতা, সোনাটিকারী, চৌবাড়িয়া, বাগবাটি-সুইলপুর, ধরাসিমলা—এসব গ্রামেও এই তাঁত আছে। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী আ ফ ম রুহুল হকের বাড়ি নলতায়। তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ব্রিটিশ আমলে এসব গ্রামের তৈরি গজ-ব্যান্ডেজের থান কলকাতায় যেত। এ অঞ্চলের পুরোনো ধনীদের কারও কারও আয়ের প্রধান উৎস ছিল এই তাঁত।

সরকারের তাঁত বোর্ডের একটি কার্যালয় আছে এ এলাকায়। এখানকার লিয়াজোঁ কর্মকর্তামো. ওবাইদুর রহমান জিলানী জানিয়েছেন, বর্তমানে ১ হাজার ৬৬৩টি তাঁত চালু আছে। এসব তাঁতে মূলত গজ, ব্যান্ডেজ ও গামছার থান তৈরি হয়। তাঁতিদের ঋণ দেয় তাঁত বোর্ড।

ছোট-বড় প্রায় সব অস্ত্রোপচারে গজ ব্যান্ডেজের ব্যবহার রয়েছে। এগুলো হতে হবে জীবাণুমুক্ত ও সুতির।

তাঁত বোর্ড সূত্র বলছে, দেশের চাহিদার ৮০ শতাংশ গজ ও ব্যান্ডেজের থান তৈরি হয় এসব গ্রামে।

তবে এসব তাঁতে তৈরি হওয়া গজ-ব্যান্ডেজের থান কতটা স্বাস্থ্যসম্মত, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের একাধিক চিকিৎসকের অভিযোগ, যে পরিবেশে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরি হয়, তা স্বাস্থ্যসম্মত না। গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত থাকার কোনো নিশ্চয়তা নেই। দ্বিতীয়ত, গজ-ব্যান্ডেজের থান কার্পাস তুলা বা কটন দিয়ে তৈরি হচ্ছে না। কার্পাস তুলার সুতার সঙ্গে মেশানো হচ্ছে ‘সিনথেটিক’ সুতা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৈরি পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় থেকে তৈরি সুতা ব্যবহার করা হচ্ছে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরিতে। তবে সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, কিছু সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নিলে সাতক্ষীরার গজ-ব্যান্ডেজের থানও স্বাস্থ্যসম্মত হয়ে উঠতে পারে।

বাপ-দাদাদের তাঁত ছিল। তাতে মশারি-শাড়ি-গামছা বোনা হতো। সে তাঁত ছিল হাতে টানা। এখন বিদ্যুতে চলে। বোনা হয় শুধু গজ-ব্যান্ডেজের থান।
আমজাদ হোসেন

সরেজমিনে গজ-ব্যান্ডেজের গ্রাম

২২ ফেব্রুয়ারি মাঘুরালী গ্রামে ঘুরে কথা হয় অনেকের সঙ্গে। গ্রামের আমজাদ হোসেনের চারটি তাঁত আছে। তিনি বলেন, ‘বাপ-দাদাদের তাঁত ছিল। তাতে মশারি-শাড়ি-গামছা বোনা হতো। সে তাঁত ছিল হাতে টানা। এখন বিদ্যুতে চলে। বোনা হয় শুধু গজ-ব্যান্ডেজের থান।’

আমজাদ হোসেনের প্রতিবেশীর দুটি তাঁত। ওই তাঁত দুটির সঙ্গে একই ঘরে থাকা, খাওয়া ও রান্নার সরঞ্জামও চোখে পড়ে। একজন নারী তাঁত দুটি চালান।

এই গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে তাঁত আছে। বাড়িগুলোতে একটি, দুটি, তিনটি, চারটি বা ১০টি করে তাঁত আছে। সবচেয়ে বেশি তাঁত আছে নলতা গ্রামের মো. নাইমুল আহছানের। নাইমুল জানালেন, ৩৩ বছর ধরে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরি করছেন। তাঁর কারখানায় ৪২টি তাঁত। কারখানায় ১১ জন শ্রমিক কাজ করেন। দৈনিক গড়ে চার হাজার গজ থান বা গজ-ব্যান্ডেজের কাপড় তাঁর কারখানায় তৈরি হয়।

মো. নাইমুল আহছান বলেন, ‘আগে গজ-ব্যান্ডেজের থান হতো কটন (কার্পাস তুলা) দিয়ে। এখন কটন থাকে ৩০-৪০ শতাংশ। বাকি ৬০-৭০ শতাংশ থাকে অন্য কিছু। এসব থান থেকে তৈরি গজ-ব্যান্ডেজ চিকিৎসার কাজে ব্যবহার করা হয়। কী দিয়ে গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত তা তলিয়ে দেখা।’

আমরা নির্ভেজাল কটনের (কার্পাস তুলা) সুতা পাই না। সুতার মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ সিনথেটিক থাকে। আমরা কী দিয়ে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরি করি, তা স্বাস্থ্য বিভাগ দেখে না
তাঁতি সমিতির সভাপতি মো. হাবিবুল্লাহ

তাঁতের মালিকেরা থান তৈরি করে স্থানীয় কয়েকজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেন। এদের মধ্যে আছেন উদয় কুমার পাল, রেজাউল করিম, আবু আহমেদ, সাধন দাশ। এসব ব্যবসায়ী নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে তাঁতিদের দেন।

তাঁতিদের একটি সমিতি আছে। সমিতির সভাপতি মো. হাবিবুল্লাহের সাতটি তাঁত আছে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘রেজাউল নারায়ণগঞ্জ থেকে সুতা এনে আমাকে দেয়, আমি থান তৈরি করে রেজাউলকে দিই। সে থান ঢাকায় পাঠায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমরা নির্ভেজাল কটনের (কার্পাস তুলা) সুতা পাই না। সুতার মধ্যে ৩০-৪০ শতাংশ সিনথেটিক থাকে। আমরা কী দিয়ে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরি করি, তা স্বাস্থ্য বিভাগ দেখে না।’

একটি থানের দৈর্ঘ্য হয় ১৮ গজ, প্রস্থ ১ গজ। একটি থানের ওজন হতে হয় ৪২০ গ্রাম থেকে ৪৫০ গ্রাম। হাসপাতাল ওজন ধরেই থান কেনে। কিন্তু তাঁতিরা ব্যবসায়ীদের কাছে থান বিক্রি করেন গজ হিসাবে।

নির্ভেজাল কার্পাস তুলার সুতা ও মিশ্রিত তুলার সুতার তৈরি থানের দামে পার্থক্য আছে। সাধন দাশ প্রথম আলোকে বলেন, নির্ভেজাল কার্পাস তুলার ১৮ গজের থানের দাম ২০০ টাকা। অন্যদিকে ৪০/৬০ (৪০ শতাংশ কার্পাস ও ৬০ শতাংশ পলিয়েস্টার) মিশ্রণের ১৮ গজের থানের দাম ১৩৫ টাকা।’ সাধন দাশ ১৩০টি তাঁতে সুতা দেন এবং ওসব তাঁত থেকে থান কেনেন। তিনি নারায়ণগঞ্জের এসএ ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল থেকে সুতা কেনেন। সপ্তাহে একবার সুতা আসে। আর রাজধানীর মিটফোর্ড এলাকার সাতক্ষীরা সার্জিক্যাল নামের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছে থান বিক্রি করেন।

অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত মুছে ফেলার বা রক্ত শুষে নেওয়ার কাজে গজ ব্যবহৃত হয়। প্রায় সব ধরনের অস্ত্রোপচারে গজের ব্যবহার আছে। হৃৎপিণ্ডের অস্ত্রোপচারে, মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে গজের ব্যবহার হয়। অস্ত্রোপচারের পর ড্রেসিংয়েও গজ দরকার হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে গজ থাকতে হয় জীবাণুমুক্ত।

সুতা ব্যবসায়ীরা কী বলেন

সাতক্ষীরার ব্যবসায়ীরা তুলা কেনেন নারায়ণগঞ্জের টানবাজার এলাকার এমন দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিকের সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়েছে। তাঁরা বলেছেন, কার্পাস তুলা বা পিসি (পলিয়েস্টার ও কটন) তুলার সুতার দামে পার্থক্য আছে। ১ পাউন্ড নির্ভেজাল কার্পাস তুলার সুতার দাম ১৫০ টাকা, আর ১ পাউন্ড পিসি সুতার দাম ৯৫ টাকা। এই ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাজারে নির্ভেজাল কার্পাস তুলার সুতার অভাব নেই। চাইলেই তাঁতিরা তাঁদের কাছ থেকে নির্ভেজাল কার্পাস তুলার সুতা কিনতে পারেন।

বিপদ কোথায়

অস্ত্রোপচারের সময় রক্ত মুছে ফেলার বা রক্ত শুষে নেওয়ার কাজে গজ ব্যবহৃত হয়। প্রায় সব ধরনের অস্ত্রোপচারে গজের ব্যবহার আছে। হৃৎপিণ্ডের অস্ত্রোপচারে, মস্তিষ্কের অস্ত্রোপচারে গজের ব্যবহার হয়। অস্ত্রোপচারের পর ড্রেসিংয়েও গজ দরকার হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে গজ থাকতে হয় জীবাণুমুক্ত।

বিদেশি গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় প্যাকেটে থাকে। প্যাকেট কেটে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায়। আমাদের গজ-ব্যান্ডেজ থাকে থান কাপড়ের আকারে। ব্যবহারের আগে প্রয়োজনমতো কাটা হয়। তারপর তা জীবাণুমুক্ত করা হয়। সব সময় জীবাণুমুক্ত হয়, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই
শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হোসাইন ইমাম

সাতক্ষীরার গ্রাম থেকে গজ-ব্যান্ডেজের থান আসে রাজধানীর বিএমএ মার্কেটে বা মিটফোর্ড মার্কেটে। সেখান থেকে তা চলে যায় দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। এর কোনো পর্যায়ে গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে দেশের হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে অস্ত্রোপচারের আগে বা ব্যবহারের আগে গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত করার বিধান আছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘অস্ত্রোপচারের আগে অটোক্লেভ মেশিনে গজ ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত করা হয়। জীবাণুমুক্ত করার নিয়ম আছে। জীবাণুমুক্ত গজ-ব্যান্ডেজই চিকিৎসককে ব্যবহারের জন্য দেওয়ার কথা।’ কিন্তু এসব গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত কি না, যথাযথভাবে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে কি না, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সেটা পরীক্ষাও করা হয় না।

শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক হোসাইন ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিদেশি গজ-ব্যান্ডেজ জীবাণুমুক্ত অবস্থায় প্যাকেটে থাকে। প্যাকেট কেটে প্রয়োজনের সময় ব্যবহার করা যায়। আমাদের গজ-ব্যান্ডেজ থাকে থান কাপড়ের আকারে। ব্যবহারের আগে প্রয়োজনমতো কাটা হয়। তারপর তা জীবাণুমুক্ত করা হয়। সব সময় জীবাণুমুক্ত হয়, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই।’

গত বছর ১২ মে একজন গণমাধ্যমকর্মীর দেড় বছর বয়সী মেয়ের বাঁ হাত পুড়ে যায়। হাতে গরম ডাল পড়েছিল। শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে শিশুটির চিকিৎসা হয়। শিশুটির হাত ব্যান্ডেজ দিয়ে মুড়ে দেন চিকিৎসকেরা। বাড়ি নেওয়ার পর শিশুটির হাত ফুলে যায়। বাবা শিশুটিকে নিয়ে আবার হাসপাতালে আসেন। এরপর ১৮ দিন শিশুটিকে হাসপাতালে থাকতে হয়েছিল। শিশুটির বাবা প্রথম আলোকে বলেন, ‘চিকিৎসকেরা আমাদের বলেছিলেন ব্যান্ডেজ থেকে সংক্রমণ হয়েছে।’

চিকিৎসক হোসাইন ইমাম জানালেন, অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে অস্ত্রোপচারের সময় শরীরের মধ্যে গজ থেকে যায়। এটা সাধারণ ভুল। সেই গজের কারণে বা অন্য কারণে রোগীর সমস্যা দেখা দিতে পারে। একটি আদর্শ গজে রেডিওলজিক্যাল মার্কার থাকে। এর ফলে এক্স-রে করলে বোঝা যায় শরীরে গজ থেকে গেছে কি না। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে এবং অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে যে গজ ব্যবহার করা হয়, তাতে এই রেডিওলজিক্যাল মার্কার থাকে না।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম দেশের একজন শীর্ষস্থানীয় শল্যবিদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে রোগীর অস্ত্রোপচারে রেডিওলজিক্যাল মার্কার আছে এমন গজই তিনি ব্যবহার করেন, দেশি গজ ব্যবহার করেন না।

স্বাস্থ্যের ক্ষতির সঙ্গে যুক্ত দুর্নীতি

চিকিৎসকেরা বলেছেন, ব্যবহারের সময় গজ থেকে সুতার ছোট ছোট টুকরা মানুষের শরীরে পড়ে। কার্পাস তুলার সুতা ‘বায়োডিগ্রেডেবল’। অর্থাৎ তা শরীরের সঙ্গে মিশে যায়। কোনো ক্ষতি হয় না।

কিন্তু পলিয়েস্টার বা অন্য সিনথেটিক ‘বায়োডিগ্রেডেবল’ না। এর কোনো টুকরা শরীরে থেকে গেলে তা নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, ‘কার্পাস তুলার সুতা না হয়ে অন্য কিছু শরীরে থাকলে তা ক্ষতি করতে পারে। কারণ, তা স্থায়ীভাবে বা দীর্ঘদিনের জন্য শরীরে থেকে যায়।’

তাঁতিরা ও ব্যবসায়ীরা বলেছেন, তিন ধরনের সুতায় গজ-ব্যান্ডেজ তৈরি হয়। শুধু কার্পাস তুলার সুতা, পলিয়েস্টার-কার্পাস তুলার মিশ্রণ এবং কার্পাস তুলা ও ব্লেন্ডেড তুলার সুতা (ব্লেন্ডেড তুলা তৈরি হয় পোশাক কারখানার ঝুট কাপড় থেকে)। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কেনে কার্পাস তুলার সুতার তৈরি গজ-ব্যান্ডেজের থান হিসেবে। এটা কেউ পরীক্ষা করে দেখে না যে, গজ-ব্যান্ডেজের থান কী সুতা দিয়ে তৈরি।

সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ উপজেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তা বুলবুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেন্দ্রীয়ভাবে গজ-ব্যান্ডেজ কিনে আমাদের সরবরাহ করা হয়। এগুলো কোন সুতা দিয়ে তৈরি, তা আমাদের পরীক্ষা করার কথা না। তা ছাড়া পরীক্ষা করে দেখার কোনো সুযোগও নেই।’

উপজেলা থেকে রাজধানীর বিশেষায়িত হাসপাতালে কাগজে-কলমে কার্পাস তুলার গজ-ব্যান্ডেজ কেনা হয়। যার দামও বেশি। কিন্তু বাস্তবে কেনা হয় সুতির সঙ্গে পলিয়েস্টারের মিশ্রণের গজ-ব্যান্ডেজ। যার দাম কম।

গজে আছে পলিয়েস্টার

এই প্রতিবেদক সাতক্ষীরার গ্রাম থেকে, উপজেলা হাসপাতাল থেকে, স্থানীয় বাজার থেকে, আড়ত থেকে এবং রাজধানীর হাসপাতাল থেকে গজের নমুনা সংগ্রহ করেন। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাগারে পাঁচটি নমুনা পরীক্ষা করা হয়। নমুনা পরীক্ষায় দেখা গেছে, পাঁচটির কোনোটি খাঁটি কার্পাস তুলার গজ না। কার্পাস তুলার সঙ্গে অন্য বস্তু মেশানো আছে।

রাজধানীর একটি সরকারি জাতীয় প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া গজের নমুনায় পলিয়েস্টার ৫০ শতাংশ, কার্পাস তুলা ২৫ শতাংশ ও ২৫ শতাংশ ভিসকোস (রেয়ন নামে পরিচিত) পাওয়া গেছে। একটি উপজেলা স্বাস্থ্য কেন্দ্রের গজের নমুনায় কার্পাস তুলা ৫৮.৫ শতাংশ, পলিয়েস্টার ৩৮.৫ শতাংশ এবং অন্যান্য বস্তু ৩ শতাংশ পাওয়া গেছে।

সাতক্ষীরার গ্রামের একটি তাঁতে তৈরি থানের নমুনায় পলিয়েস্টার ৭৭.২ শতাংশ এবং কার্পাস তুলা ২২.৮ শতাংশ পাওয়া গেছে। আড়তের থানের নমুনায় কার্পাস তুলা ৫৬.৫ শতাংশ এবং পলিয়েস্টার ৪৩.৫ শতাংশ পাওয়া গেছে।

একটি প্রতিষ্ঠানের নামে বাজারজাত করা গজে পলিয়েস্টার ৮৪.৯ শতাংশ এবং কার্পাস তুলা ১৫.১ শতাংশ পাওয়া গেছে।

অর্থাৎ চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত গজে কার্পাস তুলা ১০০ শতাংশ থাকার কথা থাকলেও কোনো নমুনায় তা ছিল না। একটি নমুনায় গজে কার্পাস তুলা পাওয়া গেছে মাত্র ১৫ শতাংশ।

উদ্বেগের কারণ

তাঁতিরা বলেছেন, নির্ভেজাল কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে তাঁরা গজ ব্যান্ডেজ তৈরি করছেন না। বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায়ও প্রতিটি নমুনায় পলিয়েস্টার এবং একটি নমুনায় পলিয়েস্টারের পাশাপাশি ভিসকোস বা রেয়ন পাওয়া গেছে।

পলিয়েস্টার একধরনের প্লাস্টিক। পলিয়েস্টার তৈরির সময় বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। পলিয়েস্টারের কাপড় পরলে অনেকের শরীরে অ্যালার্জি দেখা দেয়। পলিয়েস্টার যেহেতু শরীরের সঙ্গে মিশে যায় না, তাই শরীরে নানা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ হতে পারে। শরীরে প্রদাহ সৃষ্টি হতে পারে, টিস্যুর ক্ষতি হতে পারে। এখন সারা বিশ্বে অতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা ক্ষতির বিষয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হচ্ছে। একই ধরনের ক্ষতির ঝুঁকি আছে পলিয়েস্টার থেকে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং অনুষদের ডিন অধ্যাপক হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘গজ তৈরি হতে হয় ১০০ শতাংশ কার্পাস তুলার সুতা দিয়ে। শরীরে পলিয়েস্টার ঢুকলে ক্ষতি অবশ্যই হবে। পলিয়েস্টার একধরনের প্লাস্টিক। তবে কোন মাত্রায় ক্ষতি হয়, তা নিয়ে গবেষণা হতে পারে।’

এগোনোর পথ কী

সাতক্ষীরার তাঁতিরা নিজেদের উপলব্ধি থেকে বলেছেন, তাঁরা ভুল জিনিস দিয়ে গজ-ব্যান্ডেজের থান তৈরি করছেন। তাঁত বোর্ডের একজন কর্মকর্তাও একই কথা বলেছেন।

তাঁতি ও গজ ব্যবসায়ীরা বলেছেন, হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলো যদি কার্পাস তুলার গজ নেওয়া নিশ্চিত করে, যদি গজ পরীক্ষা করে নেওয়ার ব্যবস্থা থাকে, তা হলে অন্য সুতার গজ কেউ তৈরি করবে না। সুতরাং সিদ্ধান্তটা স্বাস্থ্য বিভাগকেই নিতে হবে।

অন্যদিকে রেডিওলজিক্যাল মার্কারসহ প্যাকেটজাত গজের দাম সাধারণ গজের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। কিন্তু সেই গজও দেশে তৈরি করা সম্ভব। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ‘রোগীর স্বার্থটাই বড়। দাম যাই হোক, সরকারি হাসপাতালে তা সরবরাহ করার দায়িত্ব সরকারের। সরকারি হাসপাতালে প্যাকেটজাত গজ ব্যবহার শুরু হলে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক সেই পথে যেতে বাধ্য হবে। এ ব্যাপারে নীতিগত সিদ্ধান্ত হওয়া দরকার বলে আমি মনে করি।’