ডিসেম্বরের দিনটা ছোট। হেমন্তের শেষ বিকেলে পাঁচটা বাজতেই তাই দিনের আলো ফুরিয়ে এল। সেই ম্লান আলোতেও একটা লম্বা গাছের মাথায় কয়েকটা রুদ্রপলাশ ফুল দেখে খুলনা শহীদ হাদিস পার্কে ঢুকে পড়লাম। গাছের মগডালের মাথায় ফোটা শুরু হয়েছে ফুলগুলো। রুদ্রপলাশ ফুলের রং হয় লাল, কিন্তু এই ফুলের রং হলুদ। এই প্রথম দেখলাম হলুদ রুদ্রপলাশ ফুল।
একটু হেঁটে সামনে পশ্চিম দিকে এগিয়ে গেলাম। চোখে পড়ল আর এক হলুদ ফুল ফোটা গাছকে। দূর থেকে ভেবেছিলাম মিনজিরি। কাছে গিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করতেই ভুল ভাঙল। মিনজিরি না, অন্য গাছ। শীতের শুরুতেই ফুল ফুটতে শুরু করেছে। মাত্র তিনটি ডালের আগায় তিন থোকা ফুলের দেখা মিলল। ভালো করে চেনার চেষ্টা করলাম।
নাহ্, এ ফুলের গাছ তো আগে চোখে পড়েনি। আমার মাথার চেয়ে খানিকটা উঁচু গাছের অণুপত্রগুলো পত্রদণ্ডের দুই পাশে ৬ থেকে ৯টি জোড়ায় সাজানো। পত্রক অবডিম্বাকার থেকে লম্বাটে ডিম্বাকার, অগ্রভাগ ভোঁতা। ওপরের পিঠ মসৃণ, নিচের পিঠ সূক্ষ্ম রোমশ ও হালকা সবুজ। সারা বছরই গাছের মাথা ঝোপাল হয়ে পাতায় ভরে থাকে। সন্ধ্যা হতেই পাতাগুলো ভাঁজ হতে শুরু করেছে।
ডালের ওপরের দিকে পাতার কোল থেকে ঊর্ধ্বমুখীভাবে থোকা ধরে ফুল ফুটেছে। শেষবেলায় ফুলগুলো মিইয়ে এসেছে। তারপরও তার গড়ন বুঝতে কষ্ট হয় না। গাঢ় হলুদ রঙের পাঁচটি পাপড়ি পুষ্পমঞ্জরির কয়েকটা ফুল তখনো মেলে রয়েছে। একটি থোকায় ফুটেছে ১০ থেকে ১৫টি ফুল।
পাপড়ির গোড়ার দিকটা সরু বোঁটার মতো, আগার দিকটা গোলাকার, গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত পাঁচটি লম্বা একটু উঁচু রেখা স্পষ্ট। পাপড়ির নিচে ছোট ডিম্বাকার পাঁচটি পাংশুটে হলুদ বৃতি পাপড়িগুলোকে ধরে রেখেছে। আর ফুলটাকে ধরে রেখেছে উজ্জ্বল হালকা সবুজ চিকন একটি বোঁটা। ফুলের মাঝখান থেকে বেরিয়ে এসেছে বাঁকানো কাঠির মতো সবুজাভ হলদে একটি স্ত্রী কেশর, তাকে ঘিরে রয়েছে তার চেয়ে খাটো কয়েকটা পুরুষ কেশর। সেগুলো বাঁকা নয়, পুরুষ কেশরের মাথায় পরাগধানীর রংটা খয়েরি হওয়ায় তা ফুলকে করেছে আরও সুন্দর। পুষ্পমঞ্জরিতে ফুলগুলো সাজানো রয়েছে চক্রাকারে।
ঢাকায় ফিরে এসে তোলা ছবি দেখে বইপত্র ঘেঁটে গাছটার নাম ও তার কিছু তথ্য জানার চেষ্টা করলাম। ট্রপিক্যাল প্লান্টস অব দ্য ওয়ার্ল্ড বইয়ে গাছটার পরিচয় পেলাম কলোমোনা নামে, উদ্ভিদতাত্ত্বিক নাম Senna surattensis, পরিবার ফ্যাবেসি, উপপরিবার সিসালপিনি। ডিকশনারি অব প্ল্যান্ট নেমস অব বাংলাদেশ গ্রন্থে এর বাংলা নাম উল্লেখ করা হয়েছে সুরতিসেনা, ইংরেজি নাম প্রিমরোজ বা গ্লোকোস কেসিয়া।
কালকাসুন্দা ফুলের সঙ্গে এ ফুলের দারুণ মিল রয়েছে। তাই ফুল দেখে বিভ্রান্তি আসতে পারে। তবে কালকাসুন্দার গাছ ছোট গুল্ম, আর সুরতিসেনার গাছ বড় গুল্ম বা ছোট বৃক্ষ। গাছ ২-৩ মিটার লম্বা হয়। তবে কোনো কোনো গাছ এর চেয়েও একটু বেশি লম্বা হতে পারে। সুরতিসেনার অন্য সহোদরেরা হলো মিনজিরি, দাদমর্দন, চাকুন্দা, তেরাজ, তিমুরসেনা, বড় চালকাসুন্দা ইত্যাদি। সুরতিসেনার ফল চ্যাপ্টা শিমের মতো, প্রায় ২০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। বাদামি হয়ে ফল পাকলে লম্বালম্বিভাবে ফেটে যায় ও ভেতর থেকে চ্যাপ্টা বীজ মাটিতে ছড়িয়ে পড়ে। বীজ থেকে চারা হয়।
যদিও এ উপমহাদেশেই এ গাছের জন্ম, তবু এ গাছটি এ দেশে স্বল্প পরিচিত। অনুর্বর মাটিতে বুনো প্রকৃতির এ গাছ প্রচুর জন্মালে সে মাটি উর্বর হয়ে যায়। বুনো প্রকৃতির গাছ হলেও বিভিন্ন বাগান ও পার্কের শোভা বাড়ানোর জন্য এ গাছ লাগানো যায়। বলতে গেলে চিরসবুজ বহুবর্ষী এ গাছ কোনো যত্ন ছাড়াই প্রায় সারা বছর ধরে কমবেশি ফুল দেয়। রোদে গাছ ভালো হয়, তবে আধো ছায়াতেও জন্মে। এ প্রজাতির গাছ সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
মৃত্যুঞ্জয় রায়, কৃষিবিদ ও প্রকৃতিবিষয়ক লেখক